রাজধানীর সড়কজুড়ে ফুটপাতে মিলছে নানা স্বাদের খাবার। এসব খাবারের প্রতি মানুষের আকর্ষণও কম নয়। রাস্তা বা গলির মোড়ে গরম চুলা থেকে নানা রকমের ভাজাপোড়া খাবারের ঘ্রাণ পাওয়া যায় পথ চলতে গিয়ে। প্রতিনিয়ত ভেসে আসা মচমচে ভাজাপোড়ার গন্ধ। সেই সঙ্গে চটপটির টক-মিষ্টি সুবাসে মন মেতে ওঠে। মুখরোচক এসব খাবার দেখে কিছুটা সময়ের জন্য পথচারীরা থমকে দাঁড়ান। আবার কেউ বা ছবি তোলেন। কেউ আবার দোকানোর মধ্যে গিয়ে খাবারের তাগাদা দেন।
টক-ঝাল মেলানো সস মিশিয়ে মজাদার খাবার খেয়ে অনেকে ‘আত্মতুষ্টি’ বোধ করেন। আবার অনেকে বাসাবাড়ির জন্য পার্সেল নিয়ে যান। আমাদের সমাজের অনেকেই সময় বাঁচাতে কিংবা ঝামেলা পরিহার করার জন্য বিকালের নাস্তা দোকান থেকে সংগ্রহ করেন। গরম গরম মুখরোচক এসব খাবার খেতে মানুষ অনেকটাই অভ্যস্ত। রাস্তার খাবারের প্রতি সব বয়সী মানুষের কমবেশি ঝোঁক থাকে।
সে কারণে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা কিংবা সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে নামিদামি খাবারের দোকান। দুপুর গড়ানোর পর ভিড় জমতে থাকে এসব দোকানে। কেউ বা খেতে কিংবা কেউ বা নিতে আসেন এসব দোকানে। এসব খাবার খেতে কিংবা কেনার জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেক সময়। দোকানি পছন্দের খাবার অর্ডার দেওয়ার পরপরই খাবার চলে আসবে এমনটা নয়। এখানেও রয়েছে অপেক্ষার পালা।
কোনো কোনো দোকানের আশপাশে রয়েছে চেয়ার। মানুষ খোলা আকাশের নিচে চেয়ারে বসে এসব খাবার খান। সমাজের সব বয়সী মানুষ রাস্তার খাবার খেতে অভ্যস্ত হলেও উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা এসব খাবারের প্রতি অনেকটাই অনুরক্ত। আর সে কারণে দিন দিন বাড়ছে পথের খাবারের বেচাকেনা। পথের ধারের খাবার বা স্ট্রিট ফুড আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমাদের খাদ্য অভ্যাসের একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে রাস্তার পাশের খাবার। রাজধানীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা মার্কেটের আশপাশে এসব খাবারের দোকান গড়ে উঠলেও এখন দেশের বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা এবং এমনকি গ্রামের হাট-বাজারেও খোলা স্থানে বিক্রি হচ্ছে তৈলাক্ত খাবার।
গ্রাম থেকে শহর, সবত্র বিকেল গড়াতেই রাস্তার পাশে পসরা সাজিয়ে বসেন ব্যবসায়ীরা। ফুচকা, চটপটি, শিঙাড়া, সমুচা, ডালপুড়ি থেকে শুরু করে নানা ধরনের ঝাল-মসলাদার মাংসজাতীয় খাবার আকৃষ্ট করছে সব বয়সের মানুষকে। কিশোর থেকে বয়স্ক, চাকরিজীবী থেকে শ্রমজীবী, সবাই কোনো না কোনোভাবে এই পথের খাবারের ক্রেতা। স্বাস্থ্যকর কিংবা অস্বাস্থ্যকর, এ কথা না ভেবে সবাই স্ট্রিট ফুড খাচ্ছে।
পথের ধারের নানা পদের খাবারের প্রতি রয়েছে মানুষের গ্রহণযোগ্যতা। কোন খাবারের স্বাদ কোন এলাকায় কেমন সেটি অনেকেরই জানা। এই জানাশোনা থেকে রাজধানীর এক স্থান থেকে আরেক স্থান ছুটে চলা।
পুরান ঢাকা, গুলিস্তান, নিউ মার্কেট, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, শ্যামলী, গাবতলী, উত্তরা, আব্দুল্লাপুর, মিরপুর, খিলগাঁও তালতলা, মালিবাগ, মগবাজার, রামপুরার এলাকার স্ট্রিট ফুড অর্থাৎ পথে পাশে গড়ে ওঠা ভাসমান খাবারের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে নানা চিত্র। নানা স্বাদের নানা খাবার নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা হচ্ছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে।
ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিকেল থেকে রাত ১০-১১টা পর্যন্ত ঢাকার রাস্তার পাশে চটপটির দোকানে চলে বেচাবিক্রি। রাজধানীর স্থানভেদে সাধারণ চটপটির দাম হয় ৩০-৫০ টাকা। তবে নানা অনুষঙ্গ যোগ করে বিশেষ মানের চটপটি ১০০-১৫০ টাকার পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। চটপটি ঢাকার স্ট্রিট ফুডের মধ্যে শীর্ষ। ফুচকা অতি জনপ্রিয় মুখরোচক খাবার। বিশেষ করে, তরুণীদের বেলায় এটি বেশ লোভনীয় একটি খাবার। তবে তরুণদের জন্য এটি কম পছন্দের নয়। নারী-পুরুষ সবাই কেন যেন ফুচকাকে একটু বেশি পছন্দ করেন। সে কারণে ঢাকার অলিগলিতে গড়ে উঠেছে অগণিত ফুচকার দোকানও। দেশে সব পণ্যের দাম হুড়মুড় করে বাড়লেও শিঙাড়া পুরির দাম সে তুলনায় বাড়েনি।
মূলত সাধারণত ছোট আকারের শিঙাড়া ৫ টাকা থেকে শুরু করে ১০ কিংবা তার বেশি দামেও বিক্রি করা হয়। এই শিঙাড়ায় আবার গরুর কলিজা ব্যবহার করে তা ২০-৪০ টাকায়ও বিক্রি হয়। শিঙাড়াকে গরিবের বিলাসী খাবার বললে ভুল হবে না। আবার চট করে ক্ষুধা নিবারণে সহজে হাতের কাছেই পাওয়া যায় শিঙাড়া। সে কারণে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী শিঙাড়ার জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। শিঙাড়ার দোকানেই মূলত সমুচা বিক্রি হয়। শীতকালে মাটির চুলায় গ্রামের দাদি নানি-মা-চাচি-ফুফুরা তৈরি করতেন নানা ধরনের পিঠা। তবে ব্যস্ত ঢাকায় অধিকাংশ মানুষের কাছেই সেসব যেন এখন স্মৃতি। তাই বলে কি ঢাকার মানুষ পিঠা খাবে না?
ঢাকায়ও খুব সহজেই মিলছে ভাপা ও চিতইসহ নানা রকমের পিঠা। সঙ্গে থাকে নানা পদের ভর্তা। গরম গরম পিঠার ঘ্রাণই আলাদা। এই পিঠা এখন ঢাকার রাস্তায় অন্যতম অনুষঙ্গ। ঢাকার এহেন কোনো এলাকা নেই, যেখানে পিঠা পাওয়া যায় না। সহজে-সস্তায় এই পিঠা পাওয়া যায় বলে এর গ্রাহকও অনেক। তবে শীতের সময়টায় এই পিঠার কদর একটু বেশিই থাকে। হালিম আদি খাবার। ঢাকার রাস্তায় এর প্রাপ্তি এখন হর হামেশাই। মাত্র ৫০-৬০ টাকায় হালিম পাওয়া যায়। স্বাদেও ভালো, আবার অল্প টাকায় ক্ষুধা নিবারণ হয়। তাই সব শ্রেণির কাছে হালিমের জনপ্রিয়তা বেশি। অধিকাংশ হালিমের সঙ্গে গরু-খাসির পায়াও বিক্রি হয়। সব মিলিয়ে ঢাকার স্ট্রিট ফুডের তালিকায় হালিম বেশ স্বকীয় অবস্থানেই রয়েছে। এদিকে ডুবো তেলে ভাজা হয় পুরি, আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু ও পাকোড়া।
এর সঙ্গে পাড়ার দোকানের ছোলা ভুনার কদর কম নয়। এসব খাবার আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী না হলেও খেতে ভীষণ মজা। তাইতো দেদার চলছে এসব ভাজাপোড়া খাবারের দোকান। ফ্রাইপ্যানের গরম তেলে মুরগির পিস আর আলুর টুকরোগুলো বাদামি করে ভেজে পরিবেশন করা হয়। দেখলেই জিবে আসে জল। ঘ্রাণটাও লোভনীয়। লোভনীয় এই খাবারের জন্ম সাহেবি রেস্তোরাঁয় হলেও এখন তা রাস্তাঘাটেও মিলছে। এসবের গ্রাহকও অনেক। সস লাগিয়ে আগ্রহসহকারে খেতে দেখা যায় রাস্তাঘাটে পাড়ার মোড়ে। মুড়ি, চানাচুর আর হরেক মসলা সংযোগে তৈরি হয় ঝালমুড়ি। এই খাবারও বেশ জনপ্রিয়। তবে আধুনিক ঝালমুড়ি আরও মুখরোচক।
শুধু মসলা নয়, পাশাপাশি ডিম, মুরগি-হাঁস-গরু-খাসি-কলিজা দিয়েও বিশেষভাবে মসলা মিশিয়ে বানানো হয় ঝালমুড়ি, যা বিক্রি হয় ঢাকার পথে পথে। এছাড়া ডিম ঝালমুড়ি কিংবা আলু ঝালমুড়িও মিলবে রাস্তাঘাটের ভাসমান দোকানে। যা এখন শৌখিন ভোজন রসিকদের কাছেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। হাতে মাখা ভিন্ন স্বাদের আচার বানানো এখন ঢাকার নান্দনিকতার একটি অংশ। কলা, বরই, চালতা, তেঁতুল, আমড়া, পেয়ারাসহ নানা ফলের সঙ্গে ধনিয়াপাতা ও মসলার মিশ্রণে ভিন্ন স্বাদের অসম্ভব মজার আচার বা ভর্তা মিলছে ঢাকার রাস্তাঘাটে। এসব একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে হবে। সেই মজার লোভে গ্রাহকরা ফিরে আসে বিক্রেতার কাছে।
ফলে ঢাকার রাজপথে আজ জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই ধরনের খাবার। তবে এলাকাভিক্তিক খাবারের চাহিদা রয়েছে যেমন, পুরোনো ঢাকার লাচ্চি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের টিএসসির মমো, গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড ও হাতিরঝিলের খাবারের জনপ্রিয়ত রয়েছে। এসব খাবার এখনো ঢাকার সর্বত্র সহজসাধ্য হয়ে পৌঁছতে পারেনি। এইসব জনপ্রিয় খাবারের পেছনে রয়েছে এক অস্বস্তিকর স্বাস্থ্যঝুঁকি। অধিকাংশ স্ট্রিট ফুডই প্রস্তুত হচ্ছে খোলা জায়গায়, ধুলো-ময়লা ও দূষিত পরিবেশে। ব্যবহৃত হচ্ছে নিম্নমানের তেল, কখনো বা পোড়া তেল। ব্যবহার করা হয় অপরিষ্কার পানি এবং অতিরিক্ত রঙ ও কেমিক্যাল। তবুও আমরা স্বাস্থ্যবিধি ভুলে ছুটে যাই এই স্বাদের টানে। কেউ কেউ যুক্তি দেন, পথের খাবারের স্বাদই আলাদা, এর আনন্দ ভিন্ন। তাছাড়া সাশ্রয়ী দাম এবং সহজলভ্যতা এই খাবারের চাহিদা ক্রমেই বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষের শখ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পথের খাবার এখন এক সামাজিক বাস্তবতা।
ঢাকা উত্তরা এলাকায় সেলিম-শম্পা দম্পতি বলেন, পথের খাবারের স্বাদ আলাদা। সপ্তাহে ২-৩ দিন ছুটে যান পথের খাবারের টানে। কখনো এর চেয়ে বেশি।
এ সময় শম্পা বলেন, সময় কাটানোর পাশাপাশি মুখরোচক খাবার না হলে চলে না। মিরপুর এলাকার চম্পা খানম ফুচকা খেতে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন মেয়েকে।
তিনি বলেন, সারাদিন বাসায় থাকি। বিকেলে একটু বাইরে আসি। ফুচকা আমি ছোটবেলা থেকে পছন্দ করি। আমার মেয়েও পছন্দ করে। তবে পাশাপাশি হালিম, শিঙাড়া ও লাচ্চি পছন্দ হয়। আগারগাঁওয়ের ষাটোর্ধ্ব আব্দুল রহিম দুই নাতি নিয়ে এসেছেন ফুচকা খাওয়ার জন্য। তিনি নিজেও খাচ্ছেন। দুই নাতি খেয়ে ভীষণ খুশি। এ সময় আব্দুর রহিম বলেন, সময় পেলে নাতিদের নিয়ে আসতে হয়।
তামান্না আক্তার বলেন, ফুটপথের খাবার অস্বাস্থ্যকর জানি কিন্তু লোভ সামতে না পেরে বারবার ছুটে আসি ফুচকা, চটপটি, হালিমের দোকানে। মোটকথা পথের খাবারে মন টানে। বাড়িতেও তৈরি করে খেতে পারেন তবুও কেন এখানে ছুটে আসেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কেন জানি বাইরের খাবারের একটি স্বাদ আলাদা। ছাত্রী জীবন থেকে খাওয়ার অভ্যাস।
মিরপুর এলাকার ব্যবসায়ী মোসারফ হোসেন বলেন, আমি ফুটপথে ৫ বছরের বেশি সময় ফুচকা, হালিম বিক্রি করি। এখানে অধিকাংশ ক্রেতা আমাকে চেনেন। আমি প্রতিনিয়ত মিরপুর এই গলিতে থাকি। তিনি বলেন, আমার এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।
উত্তরা এলাকার ব্যবসায়ী শাজাহান বলেন, ঢাকায় ২০ বছরের বেশি সময় এসেছি। প্রথমে একটি হোটেল কাজ করতাম। পরে ফুটপাতে ব্যবসা শুরু করি। এখন আমি ভালো আছি। আমার অনেক নিয়মিত কাস্টমার রয়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ (অবসরপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ড. আলাউদ্দিনের মতে, এ ধরনের খাবার নিয়মিত খেলে হজমজনিত অসুখ, খাদ্যে বিষক্রিয়া এমনকি দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতাও দেখা দিতে পারে। যদি খেতেই হয় তবে সচেতনভাবে পরিচ্ছন্ন দোকান বেছে নিতে হবে, আর বিক্রেতাদেরও স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। নইলে স্বাদের আনন্দ একদিন হয়ে উঠতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত অসুস্থতার কারণ।