রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপার

প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাসের ব্যস্ত শহর ঢাকা। ১ হাজার ৪৬৩ বর্গকিলোমিটারের এই রাজধানীতে প্রতিদিন মানুষ স্রোতের মতো জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে দিন-রাত ছুটে চলছে। কর্মজীবীরা সকালে রাস্তায় নামেন। ঘরে ফিরতে কখনো কখনো মধ্যরাত। তবুও মানুষের পথচলার যেন কোনো শেষ নেই।

কেবল সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসংখ্য শিক্ষার্থী সকাল হলেই ছুটে চলে নিজ নিজ গন্তব্যে। ব্যবাসয়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরাও রাস্তায় নামেন সকাল সকাল। আর সে কারণেই সকাল থেকেই রাস্তায় বাড়তে থাকে বিভিন্ন বয়সী মানুষের যাতায়াত।

কাজের সন্ধানে ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকে ঘরে ফেরা পর্যন্ত মানুষকে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে থাকতে হয়। পথ চলার পথে প্রতিনিয়ত ঘটছে জীবন-মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থা জনবান্ধব কিংবা নিরাপদ না হওয়ায় প্রতিনিয়ত ঝুঁকিপূর্ণ পারাপারের সঙ্গে রাজধানীবাসী অনেকটা বাধ্য হয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

যাত্রাপথে একদিকে মানুষের চাপ, অন্যদিকে যানবাহনের দৌরাত্ম্য। সেই সঙ্গে বেড়েছে ইঞ্জিনচালিত তিন চাকার অটোরিকশা। অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি এসব যানবাহন মানুষের জন্য নতুন করে উপদ্রব সৃষ্টি করছে। এসব অটোরিকশার কারণে রাজধানীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নানা রকম দুর্ঘটনা। ঢাকার ফুটপাত ভাসমান ব্যবসায়ীদের দখলে। ফলে নগরবাসীর হেঁটে চলা কিংবা দ্রুতগতির যানবাহনের দৌরাত্ম্যে ব্যস্ত রাস্তা পারাপারের সুযোগ দিন দিন সীমিত হয়ে আসছে।

নগরবিদরা বলছেন, রাজধানীতে ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস কিংবা ফ্লাইওভারের অভাবে মানুষ নিরাপদে চলাচল করতে পারছে না। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, রাজধানীতে রাস্তা পারাপারের এ ধরনের নানা অবকাঠামো সিটি করপোরেশন গড়ে তুললেও মানুষ সেগুলো ব্যবহার করছে না। মানুষকে এসব স্থাপনা ব্যবহার করার জন্য সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে উৎসাহিত করা হলেও তা কাজে অসছে না। কেননা যেখানে যে ধরনের পারাপারের স্থাপনা থাকার কথা সেখানে সেগুলো নেই। অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে এসব স্থাপনা নির্মাণ করার ফলে মানুষ তা ব্যবহারে উৎসাহ বোধ করছে না। বিগত সরকারের আমলে একশ্রেণির ঠিকাদারকে সুবিধা করে দিতেই নির্মাণ করা হয়েছে এ ধরনের অনাবশ্যক কাঠামো।

নগরবাসীর অভিযোগ, রাজধানীতে জেব্রা ক্রসিংয়ের রয়েছে দারুণ অভাব। তবে মানুষ সাধারণত জেব্রা ক্রসিং অনুস্মরণ করে না। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নানা দুর্ঘটনা। রাজধানীর অধিকাংশ ট্রাফিক সিগন্যাল পদ্ধতি সচল না থাকায় যানবাহনের চালকরা অপ্রতিরোধ্য গতিতে গাড়ি চালান। আর ব্যস্ত পথচারীরা ডানে-বামে না তাকিয়ে রাস্তা পারাপারের চেষ্টা করায় বাড়ছে নানা অঘটন। রাজধানীর অধিকাংশ সিগন্যাল ট্রাফিক পুলিশের সদস্যসংখ্যা খুবই সীমিত।

দু-একজন ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও সাক্ষাৎ মেলে না ট্রাফিক সার্জেন্টদের। যানবাহনের চালকরা ট্রাফিক সার্জেন্ট ছাড়া অন্য কাউকে পরোয়া না করার কারণে তাদের গতি বেপরোয়ায় রূপ নেয়। ফলে তাড়াহুড়া করে রাস্তা পার হতে গিয়ে পথচারীরা বিপদের সম্মুখীন হন। রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে পুলিশের সহায়তা গ্রহণের দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ছে না। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশ পথচারীকে রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নির্দেশনা দেওয়ার দৃশ্যও বিরল। ফলে পথচারী সময় বাঁচাতে ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপারের দিকে ঝুঁকছে।

রাজধানীর ফ্লাইওভার কিংবা আন্ডারপাস, ভাসমান দোকান ও ভিক্ষুকের দখলে থাকায় মানুষ এসব স্থাপনা ব্যবহারে উৎসাহ বোধ করে না। এছাড়া ফ্লাইওভার কিংবা আন্ডারপাসে একশ্রেণির উঠতি বয়সী কিশোরা আড্ডা দেয় কিংবা মাদক গ্রহণ করায় পথচারীরা থাকে আতঙ্কিত। আর সে কারণে তারা হাতের ইশারায় যানবাহন থামিয়ে রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, শহরের বহু গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নেই পর্যাপ্ত জেব্রা ক্রসিং কিংবা ফুটওভার ব্রিজ। ফলে বাধ্য হয়েই পথচারীরা চলন্ত যানবাহনের ভিড়ে হাত উঁচু করে কিংবা দল বেঁধে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে এমন চিত্র বেশি দেখা যায়। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামনে যানবাহনের গতি সীমিত রাখার নির্দেশনা রয়েছে।

রামপুরা টেলিভিশন ভবনের সামনে দ্রুতগতিতে ছুটে চলা এলোমেলো গাড়ির ভিড়ে হঠাৎ হাত উঁচু করে এক নারী কোলে সন্তান নিয়ে সড়ক পার হওয়ার চেষ্টা করেন। গাড়িগুলো আচমকা থেমে যায়, আর এই সুযোগে ওই নারী কোনোমতে রাস্তা পার হয়ে যান। পরে ওই নারী জানান, ‘আমার তাড়া আছে। আমি প্রতিদিন এভাবেই রাস্তা পার হই।’ তবে এমন তাড়াহুড়া জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে, যা তিনি হয়তো বোঝেন, তবুও নিয়ম মানছেন না।

একই স্থানে এক বয়স্ক দম্পতি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়েও সড়ক পার হতে পারছিলেন না। পরে যখন একদল মানুষ একসঙ্গে রাস্তা পার হন, তখন তারাও সুযোগ পেয়ে রাস্তা পাড়ি দেন। দম্পতির ভাষ্য, ‘বয়স হয়েছে, এখন আর ফুটওভার ব্রিজে উঠতে পারি না। ফুটওভার ব্রিজগুলো আধুনিকায়ন হলে আমাদের মতো বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষ ব্যবহার করতে পারবেন।

কাকরাইল এলাকায় ষাটোর্ধ্ব হামেদ আলী নামের এক ব্যক্তি হাতে ভারী ব্যাগ নিয়ে রাস্তা পারাপারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তবে ফুটওভার ব্রিজ কিংবা জেব্রা ক্রসি না থাকায় তিনি ব্যাগ নিয়ে সড়ক পার হয়ে যান কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে। নিয়মভঙ্গের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, কত নিয়মই তো আছে। আমরা মেনে চলতে পারি কয়টা। তিনি বলেন জানি, এটা জীবনের ঝুঁকি। তবুও কেন যেন অভ্যাস হয়ে গেছে।

এমন চিত্র শুধু রামপুরা বা কাকরাইল এলাকায় নয়, রাজধানীর শান্তিনগর, বিজয়নগর, নয়াপল্টন, বাড্ডা, ফার্মগেট, বাংলামোটর, ধানমন্ডি এবং প্রতিটি ফ্লাইওভারের দুই পাশে প্রতিনিয়ত এমন চিত্র চোখে পড়ে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় হাত বাড়িয়ে ছুটে গিয়ে চলন্ত গাড়ির ফাঁকফোকর দিয়ে পথচারীরা রাস্তা পার হচ্ছেন। এমন ঘটনা জীবনহানির ঝুঁকি তৈরি করছে। অথচ প্রতিদিনই এমন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে রাজধানীবাসী।

এয়ারপোর্ট থেকে গুলিস্তানগামী একটি বাসের চালক জানান, তিন বছর রাজধানীতে গাড়ি চালাচ্ছি। এই সময়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। পথচারীরা হাত উঁচু করে পা বাড়িয়ে দেয় চলন্ত গাড়ির সামনে। অনেক চালক জেব্রা ক্রসিংয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিত নন। তারা বলেন, সড়ক ফাঁকা থাকলে সময় বাঁচাতে গাড়ি একটু দ্রুত চালাতে হয়।

রাজধানীর সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাস্তা পারাপারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় জেব্রা ক্রসিং নেই। যেগুলো রয়েছে, সেগুলোও রঙ উঠে গেছে।

অনেক ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের উপযোগী নয়। বাধ্য হয়ে পথচারীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার হচ্ছেন। নিরাপদ সড়কের দাবিতে বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও মাঠপর্যায়ে নেই কার্যকর বাস্তবায়ন। অনেক পথচারী জানেন না জেব্রা ক্রসিং কী? জানলেও সড়কে জেব্রা ক্রসিংয়ের চিহ্ন না থাকায় নিয়ম মানা হচ্ছে না। অন্যদিকে চালকদের বড় একটি অংশ জেব্রা ক্রসিং এলাকায় গতি কমানো কিংবা থামার ন্যূনতম সচেতনতা দেখাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে পথচারীরা যেমন খুশি তেমনভাবে চলাচল করছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজের সংখ্যা বাড়ানো, বিদ্যমানগুলোকে সংস্কার ও সচল রাখা এবং জনগণকে সচেতন করার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।

নগরবিদরা বলছেন, একটি আধুনিক নগরীর জন্য নিরাপদ পারাপারের অবকাঠামো অত্যন্ত জরুরি। রাজধানীর মতো একটি ঘনবসতিপূর্ণ শহরে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে, ব্যস্ত সড়কে ও জনবহুল এলাকার পাশে জেব্রা ক্রসিং এবং ফুটওভার ব্রিজ থাকা উচিত।

রামপুরা বিটিভি ভবনের সামনে এক ট্রাফিক পুলিশ বলেন, বিটিভি ভবনের সামনে গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ত এলাকা। কারণ এখান থেকে চারদিকে বিভিন্ন গাড়ি যায়। এখানে ফুটওভার ব্রিজ নেই এবং জেব্রা ক্রসিংয়ের রঙ উঠে গেছে। পথচারীরা রাস্তা পারাপার হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তবে অনেক সময় যাত্রীরা বেপরোয়া হয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। এখানে দায়িত্ব পালনকালে সব সময় সতর্ক থাকতে হয়।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক হাদিউজ্জামান বলেন, জেব্রা ক্রসিংগুলোর পরিকল্পনামাফিক জায়গায় দিতে হবে এবং এটিকে সক্রিয় করতে উদ্যোগ নিতে হবে। পরিবহন চালকদের এ ব্যাপারে আরও সতর্ক হতে হবে। তিনি আরও বলেন, পথচারী কতক্ষণ ধরে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হতে পারবেন সেই সময় নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি কতক্ষণ পরপর মানুষের পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি দাঁড়াবে সেটাও সিগন্যালের মাধ্যমে নির্ধারণ করে দিতে হবে। গাড়ি সীমারেখা লঙ্ঘন করলে আর্থিক জরিমানার ব্যবস্থা রাখতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা আনতে আধুনিক ট্রাফিক সিগন্যালের বিষয়ে চালকদের প্রশিক্ষিত করতে হবে।

নগর পরিকল্পনাবিদ এসএম শফিকুল রহমান বলেন, জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ জরুরি প্রয়োজন। তবে সেই জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ পরিকল্পনা করে দেওয়া উচিত। কারণ অনেক ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে কিন্তু সাধারণ মানুষ ব্যবহার করছে না। কিন্তু কেন ব্যবহার করছে না। এর কারণ খুঁজে বের করে সমাধান করা প্রয়োজন। রাজধানীতে অনেক জায়গায় জেব্রা ক্রসিং রয়েছে। অনেক জায়গার রঙ উঠে গেছে। সেগুলো অবশ্যই ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে। আবার জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে চালক ও পথচারীদের সচেতন করার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, রাজধানীতে চলাচল স্বাভাবিক রাখতে ট্রাফিক আইন মেনে চলার প্রবণতা বৃদ্ধি করতে হবে। নিরাপদ সড়ক গড়তে হলে জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে সচেতনতা এবং নিয়ম মানার সংস্কৃতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।