অতীত ঐতিহ্য

হারিয়ে যাচ্ছে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী

সময়ের ব্যবধানে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় গ্রামের ঘরে ঘরে কাঁসার থালা, বাটি, গ্লাস, বদনা, জগ, কলসি, মগ, প্রদীপ, স্কুল বেল, কাজলদানি, তরবারীর হাতল ছাড়াও চন্দনকাঠ, তিলক ও সিঁদুর রাখা বক্স ছিল দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জন্মদিন, সুন্নাতে খাতনা, বিবাহ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী উপহার হিসেবে দেওয়া ছিল সামাজিক রীতি। সামাজিক উৎসবে গেলে সবচেয়ে বড় উপহার হিসেবে কাঁসার কলসিই ধরা হতো। কিন্তু সময় পাল্টেছে। প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহার ও দাপটে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতলের সামগ্রী।

ঐতিহ্য 

অতীতের ঐতিহ্য হিসেবে বাংলার গ্রামীণ সমাজে কাঁসা বা পিতলের পাত্র শুধু দৈনন্দিন ব্যবহার্য নয়, বরং সামাজিক মর্যাদা ও ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল। কারো ঘরে কাঁসার থালা, বাটি কিংবা কলসি থাকলে তাকে ধনাঢ্য পরিবারের সদস্য হিসেবে ধরা হতো। শ্বশুরবাড়ি থেকে কন্যাকে পাঠানো হতো কাঁসার সামগ্রী উপহার হিসেবে। বিশেষ করে বিবাহ অনুষ্ঠানে কাঁসার পাত্র উপহার দেওয়া মানে ছিল কন্যার ভবিষ্যতের সমৃদ্ধির প্রতীক।

শুধু গ্রামেই নয়, শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতেও কাঁসা ও পিতলের পাত্রের আলাদা মর্যাদা ছিল। সাদামাটা খাবারও কাঁসার থালায় পরিবেশন করলে তার আভিজাত্য বেড়ে যেত বহুগুণ।

প্লাস্টিকের দাপট

৯০ দশকের পর থেকে প্লাস্টিকের পণ্য বাজার দখল করতে শুরু করে। কম দাম, হালকা ও সহজে পাওয়া যায় বলে অল্প সময়েই প্লাস্টিক সাধারণ মানুষের জীবনে ঢুকে পড়ে। কাঁসার মতো ভারী ও দামি জিনিসের জায়গা দখল করে নেয় এই সস্তা ও বহুল উৎপাদিত প্লাস্টিক। ফলে ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকে কাঁসা-পিতলের পাত্র।

এখন আর চোখে পড়ে না কাঁসা-পিতলের জিনিসপত্র। সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে কাঁসা-পিতলের কলসি বা বদনার জায়গা নিয়েছে প্লাস্টিকের ট্রে, ফ্লাস্ক, কিংবা স্টিলের বাসন। বাজারে গিয়েও আর কাঁসা-পিতলের দোকান তেমন পাওয়া যায় না। এ কারণে শ্বশুরবাড়ি থেকে এখন উপহার হিসেবে কন্যা পায় প্লাস্টিকের গৃহস্থালি সামগ্রী।

শাঁখারী বাজার

তবে ব্যতিক্রম পুরান ঢাকার এলাকা শাঁখারী বাজার। এখনো শাঁখারী বাজারে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজার এখনো কাঁসার জিনিসের শেষ আশ্রয়স্থল।

সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কাঁসা-পিতলের থালা, বাটি, কলসি বা বদনা পাওয়া যায়, তবে আগের মতো সেসবের কদর বা চাহিদা নেই।

কমল সাহা নামের এক ব্যবসায়ী জানান, এখন মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজার সময়ে কাঁসা-পিতলের সামগ্রীর কিছুটা চাহিদা দেখা যায়। বিশেষ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহার হয় এই ঐতিহ্যবাহী ধাতবপাত্র। কিন্তু চাহিদা সীমিত। চাহিদা তেমন না থাকলেও কাঁসা-পিতলের সামগ্রীর দাম বেড়েছে অনেক। কাঁসা-পিতলের সামগ্রী কেজি দরে বিক্রি হয়।

বাজারে দেখা যায়, এক কেজি কাঁসার পণ্য ৪ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পিতলের কেজি দেড় হাজার টাকা। তবে কারুকাজ বেশি থাকলে দাম একটু বেশি।

এখন এই শিল্পে রয়েছে কারিগর ও কাঁচামালের সংকট রয়েছে। কাঁসার জিনিস বানাতে বিশেষ কারিগরি দক্ষতার প্রয়োজন। আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক পরিবার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী তৈরি করতেন। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন সেই কারিগরেরা পেশা বদল করেছেন। এতে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পে কারিগর সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

শাঁখারী বাজারে পরেশ সাহা নামের এক প্রবীণ কারিগর বলেন, ‘আগে ঈদ, পূজা বা বিয়ের মৌসুমে কাজের ধুম পড়ে যেতো। দিনে-রাতে ব্যস্ত থাকতে হতো কাজ নিয়ে। এখন মাসের অধিকাংশ সময় কোনো কাজ থাকে না। প্লাস্টিক সব শেষ করে দিয়েছে।’

নিখিল রায় নামের এক বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা শুধু ব্যবহারিক কারণেই নয়, নান্দনিকতার জন্যও কাঁসা-পিতলের সামগ্রীকে গুরুত্ব দিতেন। প্লাস্টিকের দাপটে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া মানে আমাদের সংস্কৃতির একটি অধ্যায় চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়া।’

গবেষকরা যা বলছেন

কাঁসা-পিতলের জিনিস শুধু টেকসই নয়, স্বাস্থ্যসম্মতও। গবেষকরা বলছেন, কাঁসার ধাতব গুণাগুণ খাবারকে দীর্ঘক্ষণ ভালো রাখে। তাছাড়া এতে জীবাণু বৃদ্ধিও ধীর হয়। অন্যদিকে, প্লাস্টিকের পাত্রে দীর্ঘদিন খাবার রাখা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। পরিবেশের জন্যও প্লাস্টিক ভয়ঙ্কর হুমকি।

সংস্কৃতি গবেষকরা মনে করেন, শুধু পূজার মৌসুমেই নয়, বরং দৈনন্দিন ব্যবহার ও সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে কাঁসা-পিতলের সামগ্রী ফিরিয়ে আনতে হবে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কাঁসা-পিতলের শিল্পকে সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় এক সময়ের গৌরবময় ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে।