আবাসিক এলাকায় তেলের কারখানা, স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা

রাজধানীর আবাসিক এলাকা বনশ্রী। যেখানে বসবাসের জন্য পরিবারগুলো ফ্ল্যাট কিনে নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এই আবাসিক এলাকার একটি ছয়তলা ভবনের নিচতলায় চলছে সরিষা তেলের কারখানা।  শুধু সরিষা তেল নয়,  এখান থেকে মসলা ভাঙানো ও প্যাকেটজাত করাসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এই কারখানার পাশে রয়েছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্থানীয় বাসিন্দা ও স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এ ধরনের কারাখানায় অটোমেশিনের মাধ্যমে সরিষা তেল ভাঙানো হয়। তেল ভাঙানোর গন্ধ ও ধোঁয়ার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। শিশু ও বয়স্করা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বনশ্রীর ডি-ব্লকের ৪ নম্বর রোডের ২৪ নম্বর বাড়ির নিচতলায় রয়েছে ‘তেল ঘর লাইভ কাঠের ঘানি’ নামের কারখানা। এই কারখানার সামনে রয়েছে ‘নিউ আইডিয়াল স্কুল’ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আবাসিক এলাকায় এ ধরনের কারখানা স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক। এটি শুধু স্থানীয়দের ক্ষতি করছে না; বরং ভবনের কাঠামোতেও ঝুঁকি তৈরি করছে। আইনের প্রয়োগ ছাড়া এ ধরনের ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়। তাই স্থানীয়রা সরকারের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তাদের দাবি, অবিলম্বে আবাসিক এলাকা থেকে কারখানাটি অপসারণ করতে হবে। স্থানীয় জনগণসহ শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় পরিবেশ অধিদপ্তরকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।

নিউ আইডিয়াল স্কুলের একাধিক শিক্ষক বলেন, এই আবাসিক এলাকায় রয়েছে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে কিভাবে একটি কারখানা চলমান থাকে? এই স্কুলের শত শত শিক্ষার্থী কারখানার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।

এক শিশুশিক্ষার্থীর মা বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে কোনো কারখানা চলতে পারে না। এই এলাকা আবাসিক আর এখানে কারখানা দিয়ে মানুষের দুর্ভোগ হয়- এমন কিছু করা ঠিক নয়। তবে  দ্রুত আবাসিক এলাকা থেকে তেলের কারখানা সরিয়ে নেওয়া উচিত।

বনশ্রীর একটি বহুতল ভবনের বাসিন্দা নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমরা পরিবার নিয়ে এখানে এসেছি শান্তিতে থাকার জন্য। কিন্তু তেল ভাঙানোর কারখানার দুর্গন্ধে আমাদের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছে।’

একই অভিযোগ করেন রফিকুল ইসলাম নামে আরেক বাসিন্দা। তিনি বলেন,  ‘আবাসিক এলাকায় এ ধরনের শিল্প-কারখানা চলতে পারে না। অথচ কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মনে হয় প্রভাবশালীরা জড়িত।’

এ সময় নাম প্রকাশ না করে এক নারী বলেন, ‘কারখানার কারণে শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে। আমরা আবাসিক এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা চাই না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তেল ভাঙানো বা মসলা গুঁড়া করার কারখানা থেকে নির্গত ধুলা ও ধোঁয়া মানুষের শ্বাসতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। দীর্ঘ মেয়াদে হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তারা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)’ অনুযায়ী কোনো আবাসিক এলাকায় শিল্প স্থাপন করা যাবে না। শিল্প স্থাপনের আগে বাধ্যতামূলকভাবে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়। এছাড়া সিটি করপোরেশনের অনুমোদন, অগ্নিনির্বাপণ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধনও প্রয়োজন হয়।

শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম ফারুক বলেন, ‘শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। যে কারণে অল্প কিছুতে শিশুরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। যে কারণে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশপাশে কারখানা থাকা ঠিক নয়। এতে শিশুরা স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে।’

আবাসিক এলাকায় তেলের কারখানা কেন এমন প্রশ্ন করলে তেলঘর নামের কারখানার চিফ মার্কেটার তারেক শাহরিয়ার উত্তর না দিয়ে উল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনি আগে বিস্তারিত জানুন।’ 

বনশ্রী আবাসিক এলাকার ‘বনশ্রী কল্যাণ সমিতি’ অফিস সহকারী মো. আকরাম বলেন, ‘ডি-ব্লকে একটি তেলের কারখানা রয়েছে বলে জানি।  তবে, এই ব্যাপারে কোনো অফিসিয়াল অভিযোগ নেই। যে কারণে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হযনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
 
বনশ্রী আবাসিক এলাকায় ‘তেল ঘর লাইভ কাঠের ঘানি’ নামের তেল কারখানার ছারপত্র রয়েছে কি না, জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের (ঢাকা মহানগর) পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘‘আবাসিক এলাকায় কারখানা তৈরি করার কোনো নিয়ম নেই। সুতরাং ‘তেল ঘর লাইভ কাঠের ঘানি’ নামের কোনো প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনার মাধ্যমে জানতে পারলাম বনশ্রী আবাসিক এলাকায় তেল কারখানা রয়েছে। সুতরাং আজ এই প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ নেওয়া হবে। এরপর পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক (বোর্ড, জনসংযোগ ও প্রটোকল) শীলব্রত কর্মকার বলেন, ‘আমি দুই মাসের ছুটিতে আছি। এই বিষয়ে আপনি রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ (চলতি দায়িত্ব) মো. আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। মো. আশরাফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আবাসিক এলাকায় কোনো শিল্প কারখানা নির্মাণের সুযোগ নেই। যে-কোনো কারখানা করতে রাজউকের অনুমোদন লাগে।  ‘তেল ঘর লাইভ কাঠের ঘানি’ কারখানার মালিক রাজউকের অনুমোদন নিয়েছে কি না, আমার জানা নেই।’’

পরিবেশ, বন ও জনবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-প্রধান তথ্য অফিসার দীপংকর বর বলেন, ‘এই বিষয়গুলো দেখভালসহ বাস্তবায়ন করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’