ত্রিমোহনীর সড়কে যানজট নিত্যদিনের ঘটনা

রাজধানী ঢাকার পূর্বাংশ হয়ে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী অঞ্চলে যাতায়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প সড়ক হলো- রামপুরা-বনশ্রী বাইপাস সড়ক। গুরুত্বপূর্ণ এই রুটের ত্রিমোহনী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রতিনিয়ত সৃষ্ট যানজট এখন এলাকাবাসীর নিত্যদিনের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সকাল-বিকেল তো বটেই, প্রায় সারাদিন ত্রিমোহনী এলাকায় দীর্ঘ যানজটে আটকে থাকে অসংখ্য যানবাহন। এতে কর্মজীবী, শিক্ষার্থী, রোগী ও ব্যবসায়ীরা পড়ছেন চরম দুর্ভোগে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ত্রিমোহনী এলাকায় এলোমেলোভাবে পার্ক করা বাস, মিনিবাস, অটোরিকশা ও ভ্যানের কারণে সড়কের অর্ধেক অংশই দখল হয়ে থাকে। ফলে সামান্য সময়ের ভেতরে পুরো এলাকাজুড়ে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি খুব কম থাকায় কিংবা থাকলেও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অকার্যকর হওয়ায় এ অব্যবস্থাপনা দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পাশাপাশি ত্রিমোহনী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়কের কিছু অংশ ইট রয়েছে। এ এলাকায় রয়েছে প্রচণ্ড ধুলা। যানজটের পাশাপাশি ধুলায় যাত্রী ও চালকদের দুর্ভোগ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ত্রিমোহনী এলাকায় যানজটের মূল ৩টি কারণ হলো- প্রথমত; ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতি। ত্রিমোহনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে স্থায়ী কোনো ট্রাফিক বক্স বা সিগন্যাল ব্যবস্থা নেই। ফলে যান চলাচল সম্পূর্ণভাবে চালকদের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করে। একদিকে বাস ঘুরানো, অন্যদিকে রিকশা বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার এলোমেলো চলাচল। সব মিলিয়ে এক অব্যবস্থাপনার পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় এমন পরিবেশ।

দ্বিতীয়ত; বাসস্ট্যান্ডের অব্যবস্থাপনা ও অপরিকল্পিত পার্কিং। ত্রিমোহনীতে কোনো নির্ধারিত বাস টার্মিনাল না থাকলেও বাসগুলো এখানে যাত্রী ওঠা-নামানোর জন্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে রাস্তার অধিকাংশ জায়গা দখল হয়ে যায়। কিছু চালক আবার যাত্রী ওঠা-নামানোর জন্য হঠাৎ করে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে দেন, যা যানজটকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

তৃতীয়ত; ছোট ছোট যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন চলাচল। রাস্তায় নিয়মিত চলাচল করছে ব্যাটারিচালিত রিকশা, নসিমন-করিমন, পণ্যবাহী ছোট ট্রাক ও ভ্যান। এদের অনেকে ট্রাফিক আইন সম্পর্কে সচেতন নন এবং যত্রতত্র গাড়ি রেখে দেন। এতে বড় যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হয় এবং মিনিটের মধ্যে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজটের সারি।

এদিকে নিয়মিত যানজটের পাশাপাশি ছোট-বড় দুর্ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই। স্থানীয়দের অভিযোগ, সড়কে অব্যবস্থাপনা এবং এলোমেলোভাবে গাড়ি ঘোরানোর কারণে একাধিকবার রিকশা, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত সোমবার দুপুরেও অছিম পরিবহনের ধাক্কায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র জুবায়েত নামের এক শিশুশিক্ষার্থী আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়।

আহত জুবায়েতের চাচা মোখলেসুর রহমান বলেন, আমার ছোট ভাই জুলহাস মিয়ার ছেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আসার সময় অছিম পরিবহন ধাক্কা দেয়। এতে গুরুতর আহত অবস্থায় আমার ভাতিজাকে প্রথমে স্থানীয় ফরাজী হাসপাতাল এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। জানি না আমার ভাতিজা সুস্থ হবে কি না? তিনি বলেন, চালকদের অব্যবস্থাপনার কারণে এই ত্রিমোহনী এলাকায় প্রতিদিন যানজটের সৃষ্টি হয় এবং দুর্ঘটনা ঘটে।

এ সময় স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, সারাদিন যানজটের চিত্র কিছুটা কম থাকলেও সকাল-সন্ধ্যা যানজট বেশি হয়। প্রতিনিয়ত যানজটের এমন চিত্র চোখে পড়ছে। যানজটের কারণে সকালে অফিস ও স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়ছে। কিন্তু যানজটের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ত্রিমোহনী বসে থাকতে হচ্ছে।

এলাকাবাসী এবং যাত্রীরা দাবি করে বলেন, ত্রিমোহনীতে যদি কার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও বাসস্ট্যান্ড সংস্কার না হয়, তাহলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সুতরাং, সময় থাকতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া প্রয়োজন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ সড়কটি রাজধানী থেকে নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে যাতায়াতের অন্যতম সহজ রুট। এই রুটে মদনপুর-কাঁচপুর-তারাবো বিশ্বরোড-ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার-মিরপাড়া চৌরাস্তা-আমুলিয়া মডেল টাউন-মেন্দিপুর-মস্ত মাঝির মোড় (ইরাম চত্বর)-নাগদারপাড় ব্রিজ-ত্রিমোহনী ব্রিজ-ত্রিমোহনী বাসস্ট্যান্ড হয়ে রামপুরা, বনশ্রী, মেরুল বাড্ডা, মধ্যবাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, শাহজাদপুর, নতুন বাজার, নর্দা হয়ে কুড়িল ফ্লাইওভার পর্যন্ত বিস্তৃত এ সড়কটি প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রীর নির্ভরতার প্রতীক। এখান দিয়ে চলে লোকাল বাস, দূরপাল্লার বাস, ট্রাক-কাভারভ্যান, প্রাইভেটকারসহ অগণিত ব্যাটারিচালিত যানবাহন। ফলে সামান্য অব্যবস্থাপনাও বড় সংকটে পরিণত হয়।

রামপুরা থেকে নারায়ণগঞ্জগামী যাত্রী হাসান মাহমুদ বলেন, ত্রিমোহনীতে কমপক্ষে আধাঘণ্টা আটকে থাকতে হয়। সকালবেলা অফিসে যেতে দেরি হয়, আবার ফেরার সময়ও একই অবস্থা। কেউই নিয়ন্ত্রণ করে না।

এ সময় তিনি আরও বলেন, এলাকার রাস্তাটা এখন দোকানদার, রিকশা ও বাসচালকদের দখলে। পুলিশের তেমন তৎপরতা নেই। মাঝে মাঝে তারা এসে দাঁড়ালেও কিছুক্ষণের মধ্যে আগের অবস্থা ফিরে আসে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ত্রিমোহনী এলাকায় যানজট নিরসনে জরুরিভিত্তিতে ৩টি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। স্থায়ী ট্রাফিক কন্ট্রোল ব্যবস্থা ও সিগন্যাল লাইট স্থাপন। নির্ধারিত বাস টার্মিনাল ও পার্কিং জোন তৈরি। ছোট যানবাহনের জন্য আলাদা লেন ও কঠোর ট্রাফিক আইন প্রয়োগ। অর্থাৎ রাস্তা ফোর-লেন করা প্রয়োজন। এছাড়া স্থানীয়ভাবে সড়ক প্রশস্তকরণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা এবং রাস্তায় নিয়মিত পুলিশ টহল নিশ্চিত করা গেলে পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতি হতে পারে বলে মনে করেন তারা।

ডেমরা ট্রাফিক জোনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ত্রিমোহনী এলাকায় অব্যবস্থাপনার বিষয়টি আমরা জানি। শিগগিরই সড়কে নিয়মিত টহল ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

খিলগাঁও থানার উপপরিদর্শক মো. ফুয়াদ জানান, ত্রিমোহনী এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়, তবে সকাল-সন্ধ্যা যানজট বেশি হয়। তিনি বলেন, সোমবার দুপুরে ত্রিমোহনী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অছিম পরিবহনের ধাক্কায় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র জুবায়েত নামের এক শিশু আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়। এ সময় বাস অছিম পরিবহন আটক করে থানায় নেওয়া হয়।

তবে স্থানীয়দের দাবি, শুধু অভিযানে নয়। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হবে। ত্রিমোহনী শুধু একটি মোড় নয়। এটি রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের অন্যতম প্রবেশদ্বার। এই রুটের প্রতিনিয়ত যানজট শুধু সাধারণ মানুষের সময় নষ্ট করছে না, অর্থনৈতিক ক্ষতিও বাড়াচ্ছে। এখন সময় এসেছে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার। যাতে ত্রিমোহনী হয়ে রাজধানীর প্রবেশ ও প্রস্থান পথটি আবারও নির্বিঘ্নে চলাচলযোগ্য হয়।