"আগুনের ঘটনার দুইদিন আগেও ঈদ নিয়ে অনেক পরিকল্পনা করছিলাম। আগুনে আমার সংসারটারে জ্বালাইয়া পুড়াইয়া শেষ কইরা দিছে। স্বামীকে কবর দিয়া পেটের তাগিদে চলে আসি গাজীপুরে। আমাদের সংসারে দুই সন্তান। ওরা গ্রামের বাড়িতেই থাকে। প্রতি ঈদে আমরা এক সঙ্গে মার্কেটে গিয়ে সবার জন্য কেনাকাটা করতাম। কিন্তু এবার আমাদের ঈদ নাই। আমি একা একা কিভাবে ঈদে বাড়ি যাব, ঘরে ঢুকলে বুকটা ফেটে যায়"।
কান্নাজড়িত কন্ঠে এসব কথা বলেন গাজীপুর কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকায় গ্যাস সিলেন্ডার লিকেজ থেকে লাগা আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আব্দুল কুদ্দুসের স্ত্রী নাজমা বেগম।
প্রতিবছর ঈদের বেতন-বোনাস পেয়ে সন্তানদের জন্য নতুন পোশাক নিয়ে একসঙ্গে বাড়ি যেতেন নাজমা ও আব্দুল কুদ্দুস দম্পতি। তবে এবার স্বামীকে হারিয়ে ঈদের সব পরিকল্পনা হারিয়ে গেছে নাজমা বেগমের। কখনও টিনসেড রুমের দরজায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকছেন, কখওবা স্বামীর ছবি দেখে অঝোরে কাঁদছেন।
তেলিরচালার ওই বাড়িতে গিয়ে এমন হৃদয়বিদারক অবস্থা দেখা যায়। পুরো এলাকায় যখন ঈদের আমেজ, তখন শুধুমাত্র ওই বাড়িটিতেই শোকের ছায়া। সেদিনের সেই ঘটনায় দগ্ধ হয়ে নিহত আব্দুল কুদ্দুস মিয়া টানা ১৭ দিন জীবন-মৃত্যুর লড়াই শেষে গত ৩০ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
একই অবস্থা নয় বছরের ছেলে সোলায়মানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রানী আক্তারের। ভাড়াবাড়ির টিনের ঘরের সামনে বসে আছেন বাকরুদ্ধ হয়ে। ছেলের কথা জিজ্ঞেস করতেই অঝোরে কান্না শুরু করেন। ছেলের সঙ্গে শেষ কী কথা হয়েছিল জানতে চাইলে সেদিনের কথা মনে করে বিলাপ করতে-করতে রানী আক্তার বলেন, ‘পুতে কইছিল আম্মা ঈদের মার্কেট করতানা তুমি। আমি কইছিলাম বাবা ছুটি হোক তহন মার্কেট করুম। আমার পুতে নাই এহন মার্কেট কার লাইগা করমু। তোমরা আমার পুতে ফিরিয়া আইনা দেও। ওরে কত দিন ধইরা দেহিনা।’
সেদিনের আগুনে দগ্ধ ৩৬ জনের মধ্যে মারা গেছে ১৭ জন। স্বজন হারিয়ে প্রতিটি পরিবারের ঈদের আনন্দ হারিয়ে গেছে। ঘটনার প্রায় ২৬ দিন হয়ে গেলেও এখনও শোকের মাতম কাটেনি।
টিনসেড রুমের সামনে মনভার করে বসে রয়েছেন শাহ আলম। পেশায় তিনি আইসক্রিম বিক্রেতা। গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর। আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে তার সাড়ে ১১ বছর বয়সী ছেলে গোলাম রাব্বি। শাহ আলম বলেন, 'আমাগের কোনো ঈদ নাই। অনেকেই বাড়িত যাইব, কিন্তু আমি বাড়িত যাইয়া কি করমু। রাব্বির বয়স যখন দেড় বছর তহন ওর মা মইরা গেছে। হেরপর থাইকা ছাওয়ালডারে আমি বড় করতাছিলাম। ছাওয়ালডার মুখখান চোহের সামনে ভাইস্যা উঠে। ছাওয়ালডা আমার হাসপাতালে খুব কষ্ট করছে। ছাওয়াল ছাড়া আমার কোনো ঈদ নাই। এরলাইগা আমি বাড়িতও যামু না।’
মঙ্গলবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, আগুনে পোড়া গন্ধ আর নতুন কোনো মরদেহের অপেক্ষায় যেন এখনও কাটছে ওই মহল্লার মানুষের দিন। দগ্ধদের ব্যথায় ব্যথাতুর পুরো এলাকা, কারও মুখে হাসি নেই। যে মহল্লায় ছিল হৈ-হুল্লোড় সেখানে অনেকটা নীরবতা। অনেকেই স্বজন হারিয়ে চলে গেছেন গ্রামে। কেউ-কেউ জীবিকার তাগিদে রয়ে গেছেন। অনেকেই দগ্ধদের চিকিৎসার জন্য এখনও হাসপাতালে পড়ে রয়েছেন।
মারা যাওয়া মহিদুল নার্গিস দম্পতির ভাই হাসমত খান বলেন, 'আমাদের হাসি ফুরিয়ে গেছে। বাসায় থাকতেই এখন কষ্ট হয়। ঈদে একসঙ্গেই গ্রামে যাইতাম, তবে আর একসাথে যাওয়া হবে না। গ্রামে গেলেও ওদের কথা মনে পড়বে। আমার পাশের রুমে সোলেমানও দগ্ধ হয়ে মারা গেছে। স্বামীকে নিয়ে তার স্ত্রী গ্রামে গেছে আর ফিরে আসেনি। বলে গেছে, যেখানে তার স্বামী মারা গেছে সেখানে আর ফিরে আসবে না'।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেলিচালা এলাকাটি শিল্প–অধ্যুষিত হওয়ায় হাজার হাজার শ্রমিক আশপাশে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। এই সুযোগে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জমি ইজারা নিয়ে কোনো রকমে টিনসেডের ঘর তৈরি করে ভাড়া দেন অনেকে। সফিকুল ইসলাম ও সুমন মিয়া নামের দুজন এখানে ঘর বানিয়ে ৬০০টি ভাড়া দেন। একেকটি কক্ষের ভাড়া ৩ হাজার টাকা করে। কক্ষগুলো ছোট, আলাদাভাবে কোনো রান্নাঘর নেই। ফলে অনেকে রাস্তায়, আবার অনেকে নিজের থাকার ঘরেই রান্নার কাজ সারেন। অল্প জায়গায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ বসবাস করায় সেখানে তৈরি হয়েছে ঘিঞ্জি পরিবেশ।
গত ১৩ মার্চ কালিয়াকৈর উপজেলার তেলিরচালা এলাকায় সন্ধ্যায় সিলিন্ডারের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসে আগুন লেগে অন্তত ৩৬ জন দগ্ধ হন। তাদের মধ্যে ৩২ জনকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কালিয়াকৈর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ কাউছার আহাম্মেদ জানান, নিহতদের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাফন কাফনের সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন তাদের খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে।