নদীর সাথে বেদে সম্প্রদায়ের প্রেম-সংসার!

যাযাবর জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন অন্যতম। তাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ সবই চলছে ভিন্ন রীতিতে। যেখানে সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব অসীম, সেখানে খুব সামান্য অনুষঙ্গ নিয়ে নৌকায় গোটা জীবন কাটিয়ে দেয় এই সম্প্রদায়ের একাংশ।

উপার্জনের ক্ষেত্রে বেদেরা নারী নির্ভরশীল এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক পেশায় যুক্ত থাকার ব্যাপারটা ভিন্ন। নারী-পুরুষ মিলেই উপার্জন করে সংসার চালান। বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন ঝাড়ফুঁক, শিঙা লাগানো, তাবিজ-কবচ বিক্রি করা, সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানোর মতো সম্প্রদায়ভিত্তিক পেশায় এখন আর খুব একটা যুক্ত নয়। কালের প্রভাবে এসবে মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে বলে, তারা নিজেদের পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছে। অবশ্য কিছুসংখ্যক বেদে এখনো সম্প্রদায় ভিত্তিক পেশায় যুক্ত।

শুক্রবার (২৭ সেপ্টেম্বর) চরফ্যাশনের মাদ্রাজ মাছ ঘাটে দেখা হয় এই সম্প্রদায়ের একাংশের সাথে। হঠাৎ পথ আগলে বলে উঠে ‘হিংসে করিস না, দশটা টাকা দিয়ে যা’ কাঠের তৈরি ছোট্ট বাক্স অথবা অ্যালুমনিয়ামের গোল কৌটা এগিয়ে দেয় আমাদের দিকে। এই আবদার জানানো মানুষগুলো ভিক্ষুক নন। তারা নিজেদের ঐতিহ্যগত পেশা ছেড়ে নতুন করে ভিক্ষাবৃত্তিতে আসা বেদে নারী। জীবন ও জীবিকার তাগিদে শত বছরের পুরোনো পেশা ছেড়ে এসব বেদে নারী কেন ভিক্ষাবৃত্তিতে নেমেছেন তারা।

স্বতন্ত্র জীবনাচার ও নিজস্ব ঐতিহ্যের অধিকারী বেদে সম্প্রদায় এখন অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। সময়ের প্রয়োজনে তাই পাল্টে যাচ্ছে জীবিকার ধরন, এমনকি জীবনবোধও। পরিবর্তিত সামাজিক বাস্তবতায় কেমন আছেন তারা? 

ঘাট এলাকায় বেদে সম্প্রদায়ের ফাতেমা, আকবর আলীর সাথে কথা হয়। তারা বলেন, ঘর-বাড়ি নাই, নৌকায় থাকি। দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে ভাসমান সংসার আমাদের। আগে বাবার নৌকায় ছিলাম। এখন স্বামীর নৌকাতে। নৌকা বদল হলেও জীবন বদলায়নি আমাদের। নদীতে ভালো মাছ পড়লে দিন একটু ভালো কাটে। তাও ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করতে গিয়েই শেষ হয়ে যায়। টাকার অভাবে ছেলে সন্তানদের কখনো স্কুলে পাঠাতে পারি না। তাই ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়েই রাস্তায় নামতে হচ্ছে। 

তারা আরও বলেন, আমাদের জীবনে আনন্দ উৎসব নেই। ভাতের জোগান করতেই কেটে যায় দিন। ডাঙায় কিছু না জুটলে নদীতে চলে যাই। নদীর উত্তাল ঢেউয়ে চাপা পড়ে যায় আমাদের আনন্দ। নদীতেই জীবন, নদীতেই মরণ। 

বেদে সম্প্রদায়ের মৌলিক চাহিদার মধ্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য কোনটাই নেই। এরা নদীতে ভাসমান অবস্থায় নদীতেই টয়লেট করে। নদীর পানিই পান করে থাকেন। এতে করে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকেন তারা। তথ্যপ্রযুক্তির ডিজিটাল বাংলাদেশের সঙ্গে তারা যেন অনেকটাই অপরিচিত। 

শত প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে উঠছে বেদে সম্প্রদায়ের একেকটি শিশু। জলবায়ু পরিবর্তনে অসংখ্য ডুবোচর তৈরি হচ্ছে ভোলার মেঘনা-তেতুলিয়া সহ অন্যান্য নদ-নদীতে। ফলে প্রাণ প্রকৃতির বৈচিত্র্যেও এর প্রভাব পড়ছে। নদীতে কমছে মাছের আনাগোনা। নদীর রূপ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বেদে সম্প্রদায়ের যারা নদীতে মাছ শিকার করে সংসার চালাত তাদের চলার পরিধি ছোট হয়ে আসছে। আর তাই বেদে সম্প্রদায়ের অনেকে ছাড়তে শুরু করেছে নদী। এখন নদী ছেড়ে কোথায় যাবে তারা? তাদের তো নেই কোনো শিক্ষা, নেই কোনো কাজের বিশেষ যোগ্যতা। 

বেদেরা হারিয়ে গেলে বাংলাদেশের পুরাতন ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির একটি অংশ হারিয়ে যাবে। তারা খুব দ্রুতই পানি ছেড়ে ডাঙ্গায় আবাস গড়তে শুরু করেছে। অথচ বছর কয়েক আগেও পুরো বেদে সম্প্রদায় বাস করতো পানিতে, খুব শিগগিরিই হয়তো তেমন দিন আসবে; যখন আর কোন বেদেকে নৌকাবাড়িতে করে নদীপথে ঘুরতে দেখা যাবে না।