জলে ভাসা জীবন: নৌকায় জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যু

নগর সভ্যতার এ যুগে মানুষ বসবাসের জন্য গড়ে তুলছেন একের পর এক পাহাড় সমান অট্টালিকা। নিরন্তর ছুটে চলেছেন আরও উন্নত জীবনযাপন, আরাম-আয়েশের খোঁজে। ঠিক একই সময়ে কারো নৌকায় জন্ম, বিয়ে, সংসার ও মৃত্যুর কথা শুনলে কিছুটা থমকে দাঁড়াতে হয়। এমন ব্যতিক্রম চিত্রও রয়েছে।

নদী কিংবা সাগরে নৌকায় ভেসে ভেসে মাছ শিকার করে চলে তাদের জীবন-সংসার। যে নদীর পানিতে জীবন, সেখানেই মৃত্যু। এ যেন জলের জীবন। এটাই তাদের নিয়তি।

নিজস্ব কোনো ভূমি না থাকায়, মৃত্যুর পর নিষ্প্রাণ দেহটা ভাসিয়ে দেওয়া হয় পানিতে। যে জলে জন্ম, সে জলেই জীবনের ইতি। ব্যতিক্রম জীবনযাপনে অভ্যস্ত এ মানুষগুলো মুসলিম হলেও, মানতা সম্প্রদায় নামে পরিচিত। মাছ শিকার করে মানুষের আমিষের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ক্ষুদ্র হলেও, দেশের অর্থনীতিতে এদের ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামেও এদের কারও কারও ভূমিকা আছে; কিন্তু সেই স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার স্বাদ কতটুকুই বা ভোগ করতে পারছেন তারা!

শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানসহ কোনো মৌলিক চাহিদাই জুটছে না তাদের ভাগ্যে। নেই স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান কিংবা বিশুদ্ধ পানির সুবিধা। পুরুষের চেয়ে এ সম্প্রদায়ের নারীর জীবন-সংগ্রাম যেন তাই খানিকটা বেশিই। জলেভাসা জীবনের ছোট্ট সংসারে তারাই যেন নিউক্লিয়াস। বহুমাত্রিক সংগ্রামের ঘাত-প্রতিঘাতে বিবর্ণ এক একটি মুখ। তবু চলছে সংগ্রাম।

স্বাধীনতার চার দশক পর ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার পেলেও নাগরিক হিসেবে কতটুকুই বা সুবিধা ভোগ করতে পারেন তারা। যারা জনপ্রতিনিধি তারাই বা কতটুকু খোঁজ রাখেন!

প্রাকৃতিক ঝড়ঝাপটা উপেক্ষা করে জীবনবাজি রেখে রাতদিন একাকার করে মাছ ধরে কোনো মতে জীবন চলে তাদের। সচেতনতা ও সুযোগের অভাবে সন্তানরা শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত। বড় হয়ে তাই বেছে নিতে হয় মা-বাবার মাছ ধরার সেই পেশাকেই। শিক্ষার সুযোগ পেলে তাদের মধ্যে থেকেও কেউ হয়তো আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারত, ভূমিকা রাখতে পারত দেশ ও জাতির উন্নয়নে।

মানতা সম্প্রদায়ের বিয়ে এবং তালাকের বিষয়টিও চমকে দেওয়ার মতো। এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় পছন্দের মেয়েটিকে তুলে নিলেই বিয়ে হয়ে যায়। আবার দাম্পত্য কলহের কারণে যদি ছাড়াছাড়ি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তাহলে ওই বধূটি স্বামীর নৌকা থেকে লাফ দিয়ে বাবার নৌকায় ফিরে এলেই তালাক হয়ে যায়। এক নৌকা থেকে অপর নৌকায় যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জীবন বদলে যায়।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে কারো কারো বিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমেও হচ্ছে। মানতা সম্প্রদায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার না করায় দিন দিন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাছ শিকারের সময় নৌকায় শিশুসন্তানকে বেঁধে রেখে পানিতে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা গেলেও বিষয়টি অমানবিকও বটে। বাল্যবিয়ে ও বহুবিবাহ এ সম্প্রদায়ের অন্যতম রীতি। 

বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে নৌকায় বসবাসকারী ৩০টি মানতা পরিবারের সরদার কাশেম জানান, তিনি এ পর্যন্ত ৫টি বিয়ে করেছেন। একাধিক বিয়ে করলে লাভ হয় তাদের। কারণ, মাছ শিকারে পুরুষের চেয়ে মেয়েরা বেশি পটু। তার ৫ স্ত্রী মাছ ধরে বিক্রির টাকা সবই তুলে দেন তার হাতে। সব মিলিয়ে ৫ স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সুখেই আছেন কাশেম।

বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ, বাবুগঞ্জ, মুলাদি, হিজলা, বানারীপাড়া, শরীয়তপুর, মাদারীপুরের কালকিনি, উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর পানপট্টি, চরমনতাজ, গলাচিপা, কালাইয়া, বগা, পাটুয়া, বদনাতলী, উলানিয়াসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নদী ও মোহনাগুলোয় এ সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার লোক নৌকায় বসবাস করছেন।

সরকারের নজরে এলে সব মৌলিক ও নাগরিক সুবিধাপ্রাপ্তির বিষয়ে আশাবাদী এ সম্প্রদায়ের লোকজন।