গুইমারায় সংঘাত: আতঙ্ক কাটছে না স্থানীয়দের, সতর্ক প্রশাসন

খাগড়াছড়ি ও গুইমারায় সংঘাতের চিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছে ঘটনাস্থল। মাথা গোজার ঠাঁই হারানো পরিবারগুলো হাহাকার করছে। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রশ্ন একটাই, কি ছিল আমাদের অপরাধ? এ অবস্থায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক কাটছে না। 

মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) অবরোধ আন্দোলনের শঙ্কায় খাগড়াছড়ি থেকে কোন দূরপাল্লার গাড়ি ছেড়ে যেতে দেখা যায়নি। তবে শহর কেন্দ্রীয় ব্যাটারিচালিত টমটম চলতে দেখা গেছে। খাগড়াছড়ি ও গুইমারার গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অতিরিক্ত পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ প্রশাসনের অবস্থান ছিল লক্ষ করার মতো।

সংঘাতের পর থেকে ১৪৪ ধারা জারিসহ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে প্রশাসন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, সেনাবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি ও আর্ম পুলিশ কাজ করছে। 

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন গুইমারার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করতে ছুটে গেছেন গুইমারার রামসু বাজারে। সঙ্গে ছিলেন- খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার,জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও গুইমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা। 

গুইমারায় সংঘাতে নিহত ৩ জনের নাম পরিচয় শনাক্ত হয়েছে। তারা হলেন- গুইমারার বটতলা পাড়ার বাসিন্দা হ্লাচাই মারমার ছেলে থোয়াইচিং মারমা (২৫), সাইংগুলি পাড়ার বাসিন্দা আপ্রু মারমা ছেলে আখ্র মারমা (২৪) ও গুইমারার হাফছড়ি গ্রাম লিচু বাগানের বাসিন্দা থোয়াইহ্লাঅং মারমার ছেলে আথুইপ্রু মারমা (২)।  

নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে তাদের পরিবারের কাছে হস্থান্তর করা হয়েছে। আজ পুলিশি নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়ি থেকে গুইমারায় নিহতের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) রিপল বাপ্পি চাকমা। 

এদিকে অবরোধ কর্মসূচি খাগড়াছড়ি জেলায় সীমাবন্ধ থাকলেও পরবর্তীতে তা পার্বত্য ৩ জেলায় বৃদ্ধি করে আন্দোলনকারীরা। 

সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টা থেকে খাগড়াছড়ি-চট্টগ্রাম-ঢাকা সড়কে শিথিল করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য ডাকা সড়ক অবরোধ। জুম্ম ছাত্র-জনতার নিজস্ব পেইজ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।

খাগড়াছড়িতে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে সকাল-সন্ধ্যা অবরোধের মধ্যেই শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে হয় খাগড়াছড়ি। সেদিন দুপুর ২টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন। 

রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) ১৪৪ ধারার মধ্যে উপজেলার খাদ্য গুদাম সংলগ্ন রামসু বাজারের মুখে আগুন জ্বালিয়ে পিকেটিং করাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর সাথে পাহাড়িদের সংঘর্ষ এবং পরে তা স্থানীয় বাঙ্গালিদের সাথে সংঘাতে জড়ায় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে।  

সংঘর্ষ চলাকালে গুলিতে ৩ যুবক (মারমা সম্প্রদায়ের) পাহাড়ি নিহত হয়। আহত হয় ১৩ সেনা সদস্য এবং গুইমারা থানার ওসিসহ ৩ পুলিশ সদস্য। সংঘাত চলাকালে গুইমারার রামসু বাজারে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আরো উত্তাপ ছড়ায় পাহাড়ে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় রামসু বাজারে পাহাড়ি-বাঙালীদের অসংখ্য বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যবহৃত মোটর সাইকেল।

এ নিয়ে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি বলে জানিয়েছে গুইমারা থানার (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ওসি মো. এনামুল হক চৌধুরী। তবে পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে তিনি জানান। প্রশাসন সম্মিলিতভাবে শর্তক আছে বলেও জানান তিনি।

খাগড়াছড়ি জেলা সদর ও গুইমারার সংঘাতের এসব ঘটনায় অসংখ্য পাহাড়ি ও বাঙালি আহত হয়। তবে কিছু সংখ্যক লোকজন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলেও বাকিরা স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন বাড়ি। 

এদিকে ধর্ষণ মামলায় অভিযুক্ত চয়ন শীল নামে এক কিশোরকে আটক করেছে পুলিশ। ওই কিশোর বর্তমানে ৫ দিনের রিমান্ডে রয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরো ২ জন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তারের দাবিতে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকে খাগড়াছড়িতে সকাল-সন্ধ্যা সড়ক অবরোধ ডাকে। 

গত শনিবার সকাল থেকে অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাঙামাটির সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সাথে দীঘিনালা, পানছড়ি, রামগড়, মহালছড়িসহ ৯ উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে।

এমন পরিস্থিতিতে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি পৌরসভা ও সদর উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং জনগণের জান ও মালের ক্ষতিসাধনের আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ১৪৪ ধারা জারি করেন জেলা প্রশাসক।

রোববার খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা অপরাধীদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না জানিয়ে ধর্ষণকারী, নারী নির্যাতনকারী, অস্ত্রধারী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। সভায় ঘটে যাওয়া সংঘাতের নিন্দা জানিয়ে দোষীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। 

অন্যদিকে সংঘাতের মধ্যে আটকরা পড়া সাজেকের কয়েক হাজার পর্যটককে প্রশাসন নিরাপত্তা দিয়ে চট্টগ্রামসহ গন্তব্যে পৌছে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম থেকে খাগড়াছড়ি প্রবেশের মুখে শতাধিক পণ্যবাহী আটকে পড়ায় স্থানীয় বাজারে খাদ্য ও নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দেয় বলে জানান স্থানীয়রা। ফলে জনদূর্ভোগও ক্রমাগত বাড়ছে। 

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার জানান, স্থানীয় ও সাধারন জনগণের জানমালের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ১৪৪ ধারা বলবৎ রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ সকল প্রশাসন কাজ অব্যাহত রয়েছে। পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা মুক্ত হলেই ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হবে বলে তিনি জানান। এ সময় বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে বলে জানান। 

বর্তমানে ১৪৪ ধারার মধ্যে অবরোধ চলাকালে খাগড়াছড়ির গুইমারার রামসু বাজারে সংঘাতের ঘটনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সতর্ক অবস্থানে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশসহ যৌথবাহিনী।