কয়েক বছর আগেও মানিকগঞ্জ জেলার সীমানাবর্তী অংশে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাট আর এই নৌপথ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত ছিল। এক সময় ফেরি পারাপারের জন্য যেখানে অপেক্ষায় থাকতো দীর্ঘ যানবাহনের সারি, হাজারো মানুষের কোলাহলে মুখর থাকতো, সেখানে বিরাজ করছে এখন নীরবতা ও হাহাকার।
আধুনিকতার ছোঁয়া আর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন যেমন মানবজাতীকে তার স্বপ্নের পদ্মা সেতু উপহার দিয়েছে। সেতু উদ্বোধনের পর থেকেই আশঙ্কাজনকভাবে যানবাহন ও যাত্রী চাপ কমতে শুরু করে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে। ফলে মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়ীর ঘাট কেন্দ্রীক হকার, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা এখন চরম দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছে। সেতুর প্রভাবে ব্যক্তি জীবনেই নয়, ঘাট কেন্দ্রীক অর্থনীতিতে নেমে এসেছে বড় ধরনের লোকসান।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরিণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা যায়, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে ছোটবড় মিলিয়ে গড়ে প্রতিদিনই ৫ থেকে ৬ হাজার যানবাহন পারাপার হতো। তবে সপ্তাহের বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার ছাড়া কোন উৎসব এলেই যানবাহনের চাপ বেড়ে যেতো কয়েক গুণ। পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন দ্রুত সময়ে চলাচলের ফলে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট দিয়ে বর্তমানে গড়ে দেড় থেকে ২ হাজারের মতো যানবাহন পারাপার হয়।
তাই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ার উভয় ঘাট এলাকায় নেই সেই চিরচেনা যানবাহনের দীর্ঘ সারি। বরং, উল্টো ফেরিগুলোকে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। যানবাহনের চাপ না থাকায় অনেক ফেরিকে বসিয়ে রাখতে হয়। যানবাহন কমে আসায় ধারণ ক্ষমতার অর্ধেক যানবাহন নিয়ে পদ্মা নদীতে ফেরি চলাচলের ঘটনাও এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় যানবাহন ও যাত্রী চাপের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল হাজারের উপরে স্থায়ী, অস্থায়ী টং দোকানসহ হোটেল থেকে বড় বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এছাড়া লঞ্চ ও ফেরি ঘাটে হকারের নির্দিষ্ট কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয় কয়েক শতাধিক হবে। সকলেই যুক্ত ছিল ঘাট কেন্দ্রীক ব্যবসায়। তবে এ নৌপথে যানবাহন পারাপার কমে যাওয়ায় এই বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখন গভীর সংকটে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর উভয় ঘাটে কয়েক হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়ে। কর্মহীনদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিবহন ও হোটেল শ্রমিকসহ কুলিরা। দীর্ঘ সময় বেকার জীবন কাটানোর পর নতুন করে কেউ কৃষিকাজ, কেউ রিকশাচালক, আবার অনেকে দিনমজুরের কাজ করে পরিবার নিয়ে কোনমতে টিকে আছে।
এক সময় যখন যানবাহনের সারি ঘাটে অপেক্ষমান থাকতো, ওই সময় ঘাটের আশেপাশের অঞ্চলের হাতে তৈরি বিভিন্ন সামগ্রি হকাররা ফেরি করে বিক্রি করতো। আগে দৈনিক যে পরিমাণ ভোগ্যপণ্য বিক্রি হতো, এখন তা প্রায় বন্ধ। ফলে এখন আর আয় নেই সেসব শ্রমিক ও সরবরাহকারীদের।
পাটুরিয়া ঘাট এলাকার ব্যবসায়ী নেতা মো. আবু সাঈদ মুন্সি বলেন, এক সময় আরিচা ঘাট ছিল জমজমাট। যমুনা সেতু উদ্বোধনের পরে ভাটা পড়ে আরিচা। সরকার নতুন করে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাট উদ্বোধন করে এবং জমতে শুরু করে ঘাট অঞ্চল। ধীরে ধীরে নতুন নতুন করে গড়ে উঠেছে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। পদ্মা নদীর দুই পারের কয়েক হাজার পরিবার এই ঘাট এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে জীবনযাপন করেছেন। কয়েক বছর আগে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট যেন মৃত অবস্থা আছে। এই ঘাট এলাকায় যারা ব্যবসা করেছে, তারা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে বেকার জীবনযাপন করেছেন। অনেক শ্রমিক হিসেবে অন্যত্র কাজ করছেন।
আবুল শিকদার নামের এক দোকানী বলেন, ঘাট এলাকায় আমি প্রায় ২০ বছর ধরে দোকান করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি। তবে এখন আর আগের মতো ভালো নাই। ঘাট এলাকার রাস্তার দুইপাশে এক সময় হাজার হাজার ছোটবড় দোকান ছিল। এখন ৯৫ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে। তারা সকলেই বেকার জীবনযাপন করছেন।
রাজিব হোসেন নামের এক হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, ঘাটে যখন যানবাহনে চাপ ছিল, তখন ২৪ ঘণ্টায় ৫০/৬০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হতো। এখন ৮/১০ হাজার হয়। অন্য কাজে যেতে না পারায় বাধ্য হয়েই করছি। পরিবার নিয়ে কোনমতে টিকে আছি।
ঘাট এলাকায় প্রায় ১৩ বছর ধরে মুড়ি বিক্রি করে সংসার চালান আলিম মিয়া। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে প্রতিদিন হাজার টাকার মুড়ি বিক্রি করেছেন। বর্তমানে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। মুড়ি বিক্রি করি এবং মাঝে মাঝে অন্যের বাড়িতে কাজ করি। তা না হলে পেটে ভাত জোগাড় করা কঠিন।
মানিকগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আব্দুস সালাম বাদল বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে যানবাহনের চাপ কমে যাওয়ায় অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে বিশাল সংখ্যক মানুষ বেকার হয়ে পড়ে। ঘাট এলাকাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার মতো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। অপরদিকে দীর্ঘ মেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পকারখানা গড়ে তোলা যেতে পারে। একটি আধুনিক, পরিকল্পিত ও ভিন্নধর্মী অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে এ ঘাটকে আবারও সচল করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরিণ নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত ডিজিএম আব্দুস সালাম বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল উন্মুক্ত করে দেওয়া পর থেকেই এ নৌরুটে যানবাহনের চাপ কমতে শুরু করে। এক সময় যানবাহন অপেক্ষায় থাকতো, আর এখন চিত্র পুরো উল্টো। আগের তুলনায় অর্ধেকের কম যানবাহন নদীপথ পার হয়। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের যানবাহন পারাপারের জন্য যে পরিমাণ ফেরি আছে, তার ৫ ভাগের এক ভাগ ফেরি দিয়েই যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। ঘাটে যানবাহন পারাপার কমে আসায় সরকারি রাজস্ব কমেছে, একইভাবে এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে।
জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, পাটুরিয়া ঘাট অঞ্চলে একটি স্কিল সেন্টারের জন্য প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে, ফুটবল ফেডারেশন থেকে টিম এসে দেখে গেছেন। মানুষের যাতে নতুন করে কর্মসংস্থান হয়, সেজন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছি, যাতে করে এখানে পর্যটনকেন্দ্র তৈরি করা হয়।