জন্ম থেকেই শারীরিক প্রতিবন্ধী লিমা খাতুন (২৪), কেবলমাত্র ডান হাত দিয়ে লিখতে পারেন। তা ছাড়া তার অন্য হাত-পা কোন কাজ করে না। এ কারণে সে হাঁটাচলা করতে পারে না। অন্যের সাহায্য ছাড়া স্থানান্তর হতে পারেন না। শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে এ বছর অনার্স ৪র্থ বর্ষ (ফাইনাল) পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন। দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত জীবনে একটু শান্তি ও স্বস্তির জন্য যেন তার চিন্তার শেষ নেই। চরম দরিদ্রতা ও অভাবের সংসারে মা পান্না খাতুনকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে চলছে তার জীবন সংগ্রাম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শারীরিক প্রতিবন্ধী লিমা নড়াইল সদর উপজেলার রতডাঙ্গা গ্রামের মৃত অলিয়ার রহমান গাজীর একমাত্র কন্যা সন্তান। তার জন্মের মাত্র ৩ বছর পর তার বাবা অলিয়ার রহমান গাজী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ক্যান্সারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হতদরিদ্র অলিয়ারের সামান্য জায়গাজমি বিক্রি হয়ে যায়।
স্বামী অলিয়ারের মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়েন অসহায় পান্না খাতুন। তিনি একমাত্র প্রতিবন্ধী শিশু কন্যা লিমাকে নিয়ে স্বামীর ভিটায় ছিলেন। প্রচণ্ড ক্ষুধা আর অভাবের তাড়নায় প্রতিবন্ধী শিশু কন্যা লিমাকে নিয়ে চলে আসেন বাবার বাড়িতে। সেই থেকেই বাবার বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার শাহাবাদ ইউনিয়নের মহাজন গ্রামে রয়েছেন।
ভাইদের আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় পান্না খাতুনকে নামতে হয় কাজের সন্ধানে। বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে ও ভাইদের সহযোগিতা নিয়ে প্রতিবন্ধী মেয়েকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী লিমাকে তার মামা বাড়ি এলাকায় বিষ্ণুপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর ওই এলাকার জেবিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করেন। সেখান থেকে এসএসসি পাস করার পর নড়াইল সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি করেন। এইচএসসি পাস করার পর লিমা নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হয়। এ বছর সে অনার্স ৪র্থ বর্ষ (ফাইনাল) পরীক্ষা সম্পন্ন করেছেন।
এই দীর্ঘ শিক্ষা জীবনে তার মা‘কে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। লিমা এমন শারীরিক প্রতিবন্ধী যে, সে কোন কাজ করতে পারে না। হাঁটা চলা করতে পারে না। নিজ হাতে খাবার খেতে পারে না। বাথরুমে যেতে পারে না। গোসল করতে পারে না। নিজের কাপড় পর্যন্ত পাল্টাতে পারে না। এসকল কাজ করে দেয় তার মা পান্না খাতুন। সে কেবলমাত্র ডান হাত দিয়ে লিখতে পারে। শিশু শ্রেণি হতে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া পর্যন্ত তাকে স্কুল-কলেজে আনা নেয়ার কাজ করেছে তার মা। হুইল চেয়ারে বসিয়ে তার মা ওই চেয়ার ধাক্কিয়ে তাকে স্কুল-কলেজে আনা নেয়ার কাজ করেন। কোলে করে ক্লাস রুমে ও পরীক্ষার হলে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে আসেন। সে একা কোন কাজ করতে পারে না। তাই সব সময় তার পাশেই থাকতে হয় তার মা‘কে। মেয়েকে ক্লাসে বা পরীক্ষার হলে দিয়ে কাছাকাছি জায়গায় থাকেন তার মা। এভাবেই চলছে তাদের মা-মেয়ের জীবনযুদ্ধ।
সারাক্ষণ মেয়ের পাশে থাকতে গিয়ে তার মা কোথাও কাজ করতে যেতে পারেন না। এ জন্য তাদের দারিদ্রতার যেন শেষ নেই।
লিমা‘র মামা সাহিনুর ভুইয়া বলেন, নিজের বোন ভাগ্নি তাদের তো আর ফেলে দেয়া যায় না। নিজেদের শত অভাব থাকা সত্ত্বেও সাধ্য অনুযায়ী তাদের সহযোগিতা করি। কিন্তু এভাবে কতদিন করা যায়? এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন অসহায় এ পরিবারটি‘র জন্য সরকারি ভাবে
কোন উদ্যোগ নিলে তারা একটু ভালো থাকতে পারতো।
প্রতিবন্ধী লিমা‘র মা বলেন, বিপিকেএস নামে একটি এনজিও হতে একটা হুইল চেয়ার দিয়েছে অনেকদিন আগে। চেয়ারটি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। প্রতিবন্ধী কার্ড আছে, সেই কার্ডে প্রতি চার মাস অন্তর ১০ হাজার টাকা দেয়। ওই টাকা ছাড়া আর কোন আয় নেই। খুব কষ্টে সংসার চালাতে হচ্ছে। মেয়েকে পড়ানো ও স্কুল কলেজে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে পান্না খাতুন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
তিনি আরও বলেন, একেতো অভাবের সংসার, কোন আয় নেই। সংসারে মাত্র দু‘জন মানুষ। তাও একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। কেউ অসুস্থ হলে আর দেখার কেউ থাকে না। রাত-দিন মেয়ের পাশেই থাকতে হয়। তাই বাসা বাড়িতে কাজ করে আয় করার কোন সুযোগ নেই। ওই মেয়েকে কোলে নিয়ে দুই-তিন তলা উপরে পরীক্ষার হলে পৌঁছে দিতে হয়েছে। আবার পরীক্ষা শেষে বাড়ি নিয়ে আসতে হয়েছে। এতো কষ্ট করে মেয়েকে পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি-হবে? একমাত্র আল্লাহ জানেন।
কেউ যদি একটু সহযোগিতা করতো বা তাকে একটা চাকরি দিতো, তা-হলে হয়তো মেয়েকে নিয়ে একটু সুখের মুখ দেখতে পারতাম।
প্রতিবন্ধী লিমা খাতুন আক্ষেপের সুরে বলেন, প্রতিবন্ধী হওয়ায় কেউ মিশতে চায়না। ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। অনেকে অহেতুক বিভিন্ন ভাবে তার ধনী বন্ধুদের পিছনে টাকা উড়ায়। অথচ তাদের জীবন জীবিকার জন্য কেউ কোন সহযোগিতা করে না। দীর্ঘ পড়াশুনা জীবনে তার কোন বন্ধু নেই। একেতো প্রতিবন্ধী, তারপর গরীব। তাই তার কোন বন্ধু নেই।
লিমা আকুতি প্রকাশ করে আরও জানায়, সংসারে কেবল সে আর তার মা। প্রধানমন্ত্রী যদি তাকে একটা ছোট চাকুরি দিতেন, তা-হলে মা‘কে নিয়ে একটু হলেও ভালো ভাবে বাঁচতে পারতাম।