রূপজানের রূপে পাগল হয়েছিলেন ব্রিটিশ যুবক

বগুড়ার নামাজগড় আঞ্জুমান-ই গোরস্তানে শায়িত আছেন অনিন্দ্য সুন্দরী রূপজান বিবি। সন্তানের জন্মদান করতে গিয়ে ১৯১৫ সালের ১০ মার্চ মাত্র ২৮ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তার মৃত্যুতে হৃদয় ভেঙে চুরমার হয় স্বামী তৎকালীন বগুড়া রেলওয়ে স্টেশনের এক ব্রিটিশ স্টেশন কর্মকর্তার।

রূপজানকে কবর দেওয়ার সময় তিনি কবরে স্ত্রীর পছন্দের সোনা-দানা, হীরা-জহরত আর রাজকীয় নানা পোশাকও কবরে রেখে দেন। সযত্নে কবরটি ইট-সিমেন্ট-পাথর দিয়ে প্লাস্টার করা হয়। কবরটির বাহ্যিক অংশে নকশা, যা ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বগুড়ার ইতিহাসের একটি অংশ হিসেবে রয়ে গেছে।

১০০ বছরেরও আগের কথা! বগুড়ার অনিন্দ্য সুন্দরী রূপজান বিবির সৌন্দর্যে পাগল হয়েছিলেন বগুড়া রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার এক ব্রিটিশ যুবক। রূপজানের মোহে রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারতেন না তিনি। তবে রূপজানকে পাওয়া অতটা সহজ ছিল না ব্রিটিশ বাবুর জন্য। কারণ তিনি ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী আর রূপজান বিবি মুসলিম পরিবারের। তাই অনেকটা উন্মাদের মতো তিনি না-কি বগুড়া রেলের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী রূপজানের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু ধর্ম ভিন্ন হওয়ায় রূপজানের বাবা বিয়েতে দ্বিমত পোষণ করেন। রূপজানের বাবার দ্বিমতে রূপজানের জন্য ব্রিটিশ যুবকের প্রাণ যায় যায় অবস্থা। রূপজানকে তার পেতে হবে। তাই সে-সময়কার বগুড়ার মুরুব্বী গোছের লোকদের কাছে তিনি অনুনয় বিনয় করে রূপজানের বাবাকে রাজি করাতে পারেন বিয়ের জন্য।

এরপর বিয়ে হয় দুজনের। বিয়ের পর না-কি রূপজানকে অনেকটা মাথায় করে রাখতেন ব্রিটিশ ‍যুবক। রূপজানের সব আবদার মানতে শিরোধার্য ছিলেন তিনি। পৃথিবীর সবকিছু রূপজানের পায়ে লুটিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন। রূপজানকে নিয়ে তিনি বগুড়ার রাস্তাঘাটে ঘোড়ার পিঠে চড়ে ঘুড়ে বেড়াতেন। রূপজান রাতের বেলা লণ্ঠন হাতে তার ইংরেজ স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতেন।

এরই মধ্যে রূপজান অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। এ ঘটনায় তাদের ‍দুজনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। তবে ওই সময় বগুড়ায় সন্তান প্রসবের জন্য আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল না। সনাতন পদ্ধতিতে দাঈ দিয়ে বাচ্চা প্রসব করানো হতো। রূপজানকে অনেক বেশিই ভালোবাসতেন তার স্বামী। বাচ্চা প্রসবে যেন কোনো জটিলতার সৃষ্টি না হয়, তাই রূপজানকে বাচ্চা প্রসব করানোর জন্য ভারতের কলকাতায় নিয়ে যান তিনি।

তবে কলকাতায় নিয়েও কোনো লাভ হয়নি। সেখানকার একটি হাসপাতালে বাচ্চা প্রসবের সময় রূপজান বিবি মারা যান। পরে তাকে বগুড়ার নামাজগড় আঞ্জুমান-ই গোরস্তানে কবর দেন। তবে তাকে কবর দেওয়ার সময় সোনা, দানা, হীরা, জহরত আর পোশাকও সেখানে রাখা হয়।

রূপজানের কবরের এফিটাফে বাংলায় লেখা রয়েছে ‘সংসারের প্রান্ত ভাগে লভিয়া জনম, দীনবেশে ছিল উচ্চ প্রণয় বৈভবে... প্রেমিকের অশ্রু জলে গাথা এই সমাধি; হে পথিক কৃপানেত্রে হেরিলে বারেক, ধন্য হবে শান্তি পাবে অন্তিম শয়নে’ ইংরেজিতে লেখা রয়েছে- ‘Here Lies Rupjan Bibi, Who died suddenly in her 28th year on 10th March 1915 in Culcutta after suffering with a most painful illness.’

এ বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা, অভিনেতা এবং নাট্যকর্মী সুপিন বর্মণ বলেন, এটি একটি প্রেমের নিদর্শন। একজন স্বামী তার স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসে সেটি রূপজান বিবির ঘটনা থেকে জানা যায়। আমরা তাজমহলের যদি কথা বলি, শাজাহান তার মমতাজের জন্য তাজমহল তৈরি করেছিলেন। বগুড়ার রূপজান বিবির ঘটনাকেও কিন্তু ওরকমভাবেই মেলাতে পারি।

বগুড়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং ইতিহাসবিদ আব্দুর রহিম বগরা বলেন, রূপজানের বাবা বগুড়ায় রেলের একটি ঘুমটি ঘরের দায়িত্ব পালন করতেন। আজকে যে সেউজগাড়ী রেলওয়ে কলোনী সেখানে ওই সময় রেলওয়ে কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা ছিল। সেখানেই রূপজানের বাবা তার পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। এটা নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধান হলে হয়তো তাদের নামও পাওয়া যাবে। বিশেষ করে ওই সময়কার রেলের কাগজপত্রগুলো পাওয়া গেলেও তাদের নাম উদ্ধার করা যেত।

তিনি বলেন, এই রূপজান বিবি এত সুন্দরী ছিলেন তার সৌন্দর্যের কথা সেই সময় বগুড়া শহরের আনাচে-কানাচে প্রচারিত ছিল। রূপজান মারা গেলে তার স্বামী খুব ব্যথিত হন। মর্মাহত হন। তার মরদেহ ট্রেনযোগে বগুড়ায় নিয়ে আসা হয়। ইসলামি শরীয়ত মোতাবেক তার দাফনের ব্যবস্থা করা হয়। নামাজগড় আঞ্জুমান ই গোরস্তানের পাশে ২ শতক জায়গা কিনে রূপজানের কবর, সমাধি সৌধ নির্মাণ করেন। এছাড়া রূপজানের নামে তার স্বামী একটি দিঘি খনন করে ‍উৎসর্গ করেন।

নামাজগড় আঞ্জুমান-ই গোরস্তানের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম নয়ন বলেন, রূপজান বিবির কবর দেখতে বগুড়া ও এর আশপাশের অনেক জায়গা থেকে প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ এখন আসেই। রূপজান ও তার কবর সম্পর্কে জানার পর দর্শনার্থীদের আগ্রহ বেড়েছে। তবে কবরটির সংস্কার করা দরকার। এর জন্য আমি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সাথে আলোচনা করেছি। কমিটিতেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা অবশ্যই এটি সংস্কার করবো।