পঞ্চগড়ে চা উৎপাদনে ধস

উত্তরের জেলা পঞ্চগড়কে বলা হয় চা উৎপাদনে দ্বিতীয় অঞ্চল। বিগত কয়েক বছর রেকর্ড হারে উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে এ জেলা। তবে বর্তমানে বিভিন্ন কারণে কমেছে উৎপাদন।

চা-বাগানে আশঙ্কাজনক হারে দেখা দিয়েছে পাতাপচা রোগ। এতে কমছে কাঁচা চা পাতার উৎপাদন। নানা ওষুধ প্রয়োগ করেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ফল।

চাষিরা বলছেন, চা গাছের কুঁড়ি থেকে নতুন পাতা বের হওয়ার পর তা পচে কালচে হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। নানা ওষুধ প্রয়োগ করেও কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না, বরং বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ। আরেকদিকে সারের সংকট দেখা দিয়েছে। ইউরিয়া ছাড়া অন্য সার পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। চা পাতায় পচা রোগ ও সার সংকটে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। 

জেলার বিভিন্ন চা বাগানে দেখা গেছে, পোকার আক্রমণ ও পাতা পচা রোগ। ফলে পাতার উৎপাদন কমে যাওয়ায় কাঁচা পাতার সংকটে কারখানাগুলোও। অধিকাংশ কারখানা এক শিফট চালু রেখেছে, কেউ কেউ আবার একদিন পরপর বা সপ্তাহে মাত্র ২–৪ দিন কারখানা চালাচ্ছে। ফলে কারখানা মালিক থেকে শুরু করে শ্রমিকরা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গাছের কুঁড়ি থেকে নতুন পাতা বের হতেই যাচ্ছে পচে।

আরেকদিকে পাতায় পাতায় পোকার আক্রমণ। কীটনাশক ব্যবহারেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না পোকার আক্রমণ ও পচা রোগ নিয়ন্ত্রণ। বাগান বাঁচানোর লড়াইয়ে বিভিন্ন কীটনাশক ক্রয় ও শ্রমিক খরচে বাড়ছে উৎপাদন খরচও। তবে পাতার দাম স্বস্তিতে থাকলেও পোকা ও পচা রোগের কারণে বিপাকে পড়েছেন চাষিরা।

চাষিরা বলছেন, চলতি বছরে পঞ্চগড়ে প্রত্যাশিত বৃষ্টিপাত নেই। এবার প্রচন্ড খরার প্রভাব পড়েছে চা শিল্পে। আরেকদিকে বাগানে লাল মাকড়, কারেন্ট পোকা ও লোফারের আক্রমণ বেশি থাকার কারণে কমছে চা পাতার উৎপাদন। সংকটের মধ্যেই নতুন করে পাতাপচা রোগ যেন মরার ওপর খরার ঘা’ পরিস্থিতি। এসব রোগ দ্রুত বাগানে ছড়িয়ে পড়ে গাছের নরম ডগা কালচে রঙ ধারণ করে পচে শুকিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে চা পাতা উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। 

২০২৩ মৌসুমের তুলনায় কমেছে চায়ের উৎপাদন। গত মৌসুমে (২০২৪) উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার সমতল ভূমিতে উৎপাদিত হয়েছে ১ কোটি ৪৩ লাখ ৯০ হাজার ১৫১ কেজি চা। যা আগের মৌসুমের চেয়ে ৩৫ লাখ ৫৭ হাজার কেজি কম। গত মৌসুমে জাতীয় উৎপাদনের ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ চা সমতল ভূমি থেকে যুক্ত হলেও এবার যুক্ত হয়েছে ১৫.৪৭ শতাংশ। অতিরিক্ত খরা, কাঁচা চা পাতার দাম না পেয়ে চাষিদের বাগান পরিচর্যায় অনেকটা অনীহা ও কিছু বাগান নষ্ট করে ফেলার কারণে উৎপাদন কিছুটা কমেছে বলে দাবি চা বোর্ডের। 

জেলার আজিজুল হক, কামাল হোসেন ও মোতাহেরসহ কয়েকজন চা চাষি জানান, চলতি মৌসুমে চা পাতার দাম ২৪-২৫ টাকা পর্যন্ত কারখানায় দিতে পারছি। যদিও মৌসুমের শুরুতে ১৫ থেকে ১৬ টাকা ছিল। পরে পাতার দাম বেড়েছে। এরপরও বিভিন্ন সমস্যার কারণে পাতার উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ দামে আমাদের পোষাচ্ছে না। নতুন করে পাতাপচা রোগে বিপাকে পড়েছি। চা বাগান টিকিয়ে রাখতে সার-কীটনাশকসহ নানা ওষুধ প্রয়োগ করতে গিয়ে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে।

আরও কয়েকজন জানান, বাগানে লাল মাকড়, লোফার ও কারেন্ট পোকার আক্রমণের পাশাপাশি এখন নতুন সমস্যা পাতা পঁচা রোগ। ওষুধ প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছে না। এখন দাম বেশি হলেও আমাদের খরচও অনেক বেড়েছে।

আরেকদিকে চা শিল্পের তৃতীয় অঞ্চল ও উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকার পরেও চা চাষে আলাদাভাবে নেই সারের বরাদ্দ।

চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে পঞ্চগড়ে সারের চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয় ইউরিয়া ৪৫ হাজার ৯৮২ মেট্রিকটন, টিএসপি ১৪ হাজার ৯১৬, ডিএপি ১৭ হাজার ২৪৫, এমওপি ২২ হাজার ৫৪৬ মেট্রিকটন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় অতিরিক্ত ১ হাজার মেট্রিকটন সার বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়।

এই বরাদ্দের ভিত্তিতে ৫ উপজেলায় সার বিভাজন করা হয়। কিন্তু এ বরাদ্ধে নেই চাষের ক্ষেত্রে। 

চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, উত্তরাঞ্চলের এ জেলায় নিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান রয়েছে ১ হাজার ৬৫টি, বড় চা বাগান রয়েছে ৮টি। অনিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে ৫ হাজার ৮৫৫, বড় চাবাগান রয়েছে ২০টি। জেলায় মোট নিবন্ধিত চা বাগান ১ হাজার ৪৭৩ ও অনিবন্ধিত চাবাগান রয়েছে ৫ হাজার ৮৭৫ টি। ১০ হাজার ২৬৭.২৮ একর জমিতে আবাদকৃত বাগানে সবুজ চা পাতা উৎপাদিত হচ্ছে চা।

বৃহৎ এ অঞ্চল জুড়ে চা আবাদ হলেও এখন আলাদাভাবে চা চাষের জন্য আলাদাভাবে নেই সার বরাদ্দ। ফলে বোরো-আমনের বরাদ্দের সার ব্যবহার হওয়ায় চা চাষিরা ভুগে থাকেন সার সংকটে। আরেকদিকে বোরো-আমনের বরাদ্দের সার চা বাগানে ব্যবহার হওয়ায় সার সংকটে ভুগছেন আমন-বোরো চাষিরা। 

১৯৯৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হলেও ২০০০ সালের দিকে শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা চাষ। তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড ও কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের হাত ধরে চা চাষের শুরুর পর পরের বছর বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর একটি একটি উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয় এ জেলায়। জেলার মতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, ইসহাক আলী মন্ডল, আবদুর রহমান ও আবুল হোসেনসহ ৬-৭ জন ক্ষুদ্র চাষির মাধ্যমে বাড়তে থাকে চা চাষের পরিধি।

এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি হয়ে উঠে হাজার হাজার হেক্টর সবুজ চা-বাগান। চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ চা বোর্ড কৃষকদের চা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে ঋণ ও বিভিন্ন উৎসাহ প্রদান করেন। বাগানের কাঁচা পাতা বিক্রি করে হাতে নগদ অর্থ আসার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকের বাড়ির আঙিনাটুকুও হয়ে উঠেছে চা-বাগান। দুই যুগের চায়ের নিরব বিপ্লবে অর্থনীতিতে বদলে যায় উত্তরাঞ্চলের প্রান্তিক জেলাটি। 

উত্তরের এ চা শিল্পে কর্মসংস্থান হয়ে হাজার হাজার নারী-পুরুষের। লক্ষাধিক মানুষ জড়িত চা শিল্পে। বেকারদের একটি বড় অংশ চাকরি ছেড়ে দিয়ে চা চাষে বিনিয়োগ করছেন। এতে হাজার হাজার নারী-পুরুষের কাজের কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থনীতিতেও স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা।

চা অর্থকরী ফসল হিসেবে বছরের ৯ মাস চলে বাগানের বিভিন্ন কাজ। বাগানের পরিচর্যা হিসেবে ফ্লাইং কাটিং অর্থাৎ গাছের মাথা ফ্লাইং কাটিং, সার ও কীটনাশক স্প্রে পানি নিষ্কাশনের কাজ করা হয়। প্রায় সারাবছরই কাজ চলে চা বাগানে। কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে চা কারখানাগুলোতেও।

কিন্তু অর্থনীতির অন্যতম এ খাতে নেই আলাদা কোন সারের বরাদ্দ। চা চাষিদের অভিযোগ, জেলায় প্রচুর চা আবাদ হচ্ছে। কিন্তু চা আবাদের জন্য কোন সারের বরাদ্দ নেই। যা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে তা চা চাষের জন্য সারের তীব্র সংকট। এ কারণে সারের ডিলার ও ক্ষুদ্র সার বিক্রেতাদের কাছ থেকে চড়া দামে সার কিনতে হচ্ছে। সার পাওয়া যাচ্ছে না। সারের ডিলাররা দাম বেশি দিলে অনেক সময় সার পাওয়া যায়। তাই এ শিল্পে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতি চা চাষে আলাদা করে সার বরাদ্দ দিয়ে বারবার দাবি জানিয়ে আসছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। 

তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, চা বাগানের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সার বরাদ্দ দেয় না। এটা দেয়ার কথা চা বোর্ডের। আমনের জন্য বরাদ্দকৃত সার চাষিরা চা বাগানসহ অন্যান্য ফসলে ব্যবহার করছেন। তাই এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

তেঁতুলিয়া উপজেলা কৃষি অফিসার তামান্না ফেরদৌস জানান আগের মতোই সারের চাহিদা দেওয়া হয়েছে। এবার চাহিদা অনুযায়ী বিভাজনও করা হয়েছে। কিন্তু চা-সহ বিভিন্ন আবাদের কারণে সারের সংকট দেখা দিতে পারে। আরও সারের প্রয়োজন রয়েছে।  

চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন জানান, চা চাষের জন্য আলাদাভাবে কোন সারের বরাদ্দ নেই। কৃষি উৎপাদনে যেসব সার বরাদ্দ হয়, তা থেকেই চা বাগানে সার ব্যবহৃত হয়।

চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আরিফ খান বলেন, প্রচন্ড খরা ও গরমের কারণে প্রথমে লাল মাকড়, পরে লোফারের আক্রমণ হয়। এগুলো দমনের পর শুরু হয়েছে পাতাপচা রোগ। আমরা চাষিদের কপার, হাইড্রোক্সাইড বা অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক ২ দফায় স্প্রে করার পরামর্শ দিচ্ছি। এতে আক্রান্ত বাগানে রোগ কমছে। কয়েক দিন আগে দৈনিক পাতা সংগ্রহ নেমে গিয়েছিল ৩ লাখ কেজিতে, যা এখন বেড়ে ৫ লাখে দাঁড়িয়েছে।

আশা করা হচ্ছে, পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হবে এবং এবার সমতলে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হবে। আর সারের যে বিষয়টি, আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সারের চাহিদা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে থাকি। সেখান থেকে যা বরাদ্দ হয়ে আসে তা ডিলারের মাধ্যমে চাষিরা সংগ্রহ করে ব্যবহার করে থাকে। 

চা উৎপাদন কমে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বছর চা উৎপাদন কমে গিয়েছিল এটা সত্য। তবে এ বছর সরকারি রেকর্ডে বেড়েছে। 

জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুল মতিন জানান, একই চাষি চা বাগান এবং আমন চাষাবাদে সার ব্যবহার করছেন। চা বাগানের জন্য সার বরাদ্দ পাই না। যার কারণে এই সংকট। চা বাগানসহ হিসেব করলে অবশ্যই সারের বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন।

মূলত, চা বাগানের জন্য সার বরাদ্দ দেয়ার কথা শিল্প মন্ত্রণালয়ের। আমরা বারবার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য চা বোর্ডকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা কোন উদ্যোগ নেয়নি।