সমতলে দিগন্তজুড়ে সবুজায়ন, টি ট্যুরিজমের অপার সম্ভাবনা 

চট্টগ্রাম-সিলেটের পর চায়ের জেলা পঞ্চগড়। দিগন্তজুড়ে সমতলের বুকে চায়ের সবুজের হাতছানিতে অপরূপ শোভাবর্ধিত এ জেলা। ভারত-নেপালের পাশে অবস্থিত জেলাটি হিমালয়কন্যা খ্যাত হয়ে ওঠায় পর্যটন অঞ্চল হিসেবে সর্বাধিক পরিচিতি পেয়েছে।

৩ দিক থেকে কাটাতারের বেড়ার ২৮৮ কিলোমিটারের সীমান্তজুড়ে নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আকর্ষণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। সবুজের আকর্ষণকে বহুগুণে সমৃদ্ধ করেছে সমতলের বুকে গড়ে ওঠা চা বাগান। পর্যটনে বহুমাত্রিক মাত্রা তৈরি করেছে সবুজ চা শিল্প।

এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি হয়ে ওঠে হাজার হাজার হেক্টর সবুজ চা বাগান। চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিকল্পনায় কৃষকদের চা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে ঋণ ও কাঁচা পাতা বিক্রির অর্থ প্রাপ্তিতে কৃষকের বাড়ির আঙিনাটুকুও হয়ে উঠেছে চা-বাগান। ২ যুগের চায়ের নিরব বিপ্লবে অর্থনীতির সাথে বদলে গেছে পর্যটন শিল্পও।

‘দুটি পাতা একটি কুড়ি’র নয়নাভিরাম চারণ ভূমি সিলেট ও চট্টগ্রামের পর সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে সমৃদ্ধ হয়েছে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়। সবুজ শ্যামলে চোখ জুড়ানো চা শিল্প ঘিরে এ জেলাটি চা বাগানে তৃতীয় ও উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকায় প্রচুর সম্ভাবনা তৈরি করেছে টি ট্যুরিজমে।   

এ জেলায় ১৯৯৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চা চাষ শুরু হলেও ২০০০ সালের দিকে শুরু হয় বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চা চাষ। তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড ও কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেটের হাত ধরে চা চাষ শুরুর পর পরের বছর বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) এর একটি উপকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয় এ জেলায়।

জেলার মতিয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলাম, ইসহাক আলী মন্ডল, আবদুর রহমান ও আবুল হোসেনসহ ৬-৭ জন ক্ষুদ্র চাষির হাত ধরে অঞ্চলটি হয়ে উঠেছে সবুজ অরণ্যের সৌন্দর্যের এলাকা।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, উত্তরাঞ্চলের এ জেলায় নিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান রয়েছে ১ হাজার ৬৫টি, বড় চা বাগান রয়েছে ৮টি। অনিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে ৫ হাজার ৮৫৫টি, বড় চা বাগান রয়েছে ২০টি। জেলায় মোট নিবন্ধিত চা বাগান ১ হাজার ৪৭৩টি ও অনিবন্ধিত চাবাগান রয়েছে ৫ হাজার ৮৭৫টি।

১০ হাজার ২৬৭.২৮ একর জমিতে আবাদকৃত বাগানে সবুজ চা পাতা উৎপাদিত হচ্ছে চা। চা বাগান ঘিরে গড়ে উঠেছে ২৮টি চা কারখানা। এসব কারখানায় সবুজ পাতার ঘ্রাণে উৎপাদিত হয় চা। এসব চা নিলাম কেন্দ্রসহ বিভিন্নভাবে বিক্রির মাধ্যমে পৌছে যাচ্ছে বিভিন্নজনের হাতে। 

উত্তরের সমতলের এসব চা বাগান এক দিকে যেমন এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে এনেছে নতুন গতি। তেমনি এর অপার সৌন্দর্য সম্ভাবনা জাগিয়েছে পর্যটন শিল্পেও। জেলার বিভিন্ন এলাকায় চোখ যে দিকে যায়, দেখা মেলে শুধু সবুজ চায়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য।

চা শিল্প টি টিট্যুরিজমে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করছে। সিলেটের মৌলভীবাজারের মতো চা বাগানের অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন পর্যটকরা। এপার-ওপার বাংলার আন্তঃসীমানা চা বাগান উপভোগ করতে পারছেন তারা।

এ অঞ্চলে সমতল ও কোথাও উচু-নিচু ঢেউ তোলা জমিতে বিস্তৃত চা বাগানের সবুজের নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেকোন সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকের মন কাড়ছে ২ দশকের বেশি সময় ধরে। এ অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক চা বাগান, যা দেশের অন্য কোথাও নেই। প্রতিদিন অগণিত পর্যটক এখানকার দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখা ছাড়াও অতি আগ্রহে চা বাগানগুলো দেখছে, ছবি তুলছে, সে ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছে। 

সবুজ চা বাগান ঘিরে এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা-বাণিজ্য। পর্যটন শিল্প ঘিরে গড়ে উঠছে রিসোর্টসহ বিভিন্ন আবাসিক হোটেল-রেস্তোরাঁ। তেঁতুলিয়া রওশনপুরের জেমকন গ্রুপের কাজী এন্ড কাজীর টি এস্টেটে ‘আনন্দধারা রিসোর্ট’, ডাহুক টি রিসোর্ট ও সম্প্রতি কালান্দিগঞ্জে গড়ে উঠেছে টি ভ্যালি গ্রিন রিসোর্ট।

যদিও কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেটের আনন্দধারা রিসোট পর্যটকদের জন্য বড় একটা আকর্ষণ। কিন্তু এখানে প্রবেশাধিকার সীমিত। এসব রিসোর্ট দিনদিন পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠেছে গুরুত্বের। 

রিসোর্ট ছাড়াও এ জেলার বিভিন্ন নদ-নদীর তীরবর্তী বেশ কিছু চা বাগানের মধ্যে রয়েছে- ডাহুক টি এস্টেট, করতোয়া চা বাগান, সীমান্তবর্তী কাজী এন্ড কাজী টি এস্টেট, স্যালিলান টি এস্টেট, ট্রিপল জেড টি এস্টেট, এম এম টি এস্টেট, ময়নাগুড়ি টি এস্টেট ও ঠাকুরগাঁও এর গ্রিন ফিল্ড টি এস্টেট। এসব বৃহৎ টি স্টেটগুলো টি ট্যুরিজমের গুরুত্ব বহন করছে। 

সমতলের চা বাগান ছাড়াও কৃষিভিত্তিক পর্যটনে বাড়ছে ইকো ট্যুরিজমের সম্ভাবনা। গত ৪ বছর ধরে তেঁতুলিয়ার সীমান্তঘেষা দর্জিপাড়া-শারিয়ালে ইকো ট্যুরিজম নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি এনজিও ইএসডিও। প্রান্তিক চাষিদের নিয়ে সংস্থাটি বিদেশি শীতকালিন উচ্চ মূল্যের ফুল টিউলিপ চাষ করে এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্পে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।

প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত টিউলিপ মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে হাজার হাজার পর্যটকদের। পর্যটন শিল্পের গুরুত্বকে কাজে লাগিয়ে এ অঞ্চলে মহানন্দা ইকো কটেজ’ নামের বিলাসবহুল প্রথম শ্রেণির আবাসিক হোটেল গড়ে তুলেছেন সংস্থাটি।

পর্যটন সংশ্লিষ্ট মনে করছেন, বাগানগুলোতে যদি পর্যটকদের ভ্রমণ বিলাসের জন্য বিশেষ রিসোর্ট, হোটেল ও বাংলো গড়ে তোলা যায়, তাহলে পর্যটন শিল্পে যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। 

তারা বলছেন, এখানকার চা বাগানগুলোতে মনোমুগ্ধকর সবুজের চা বাগান। চোখ যতদূর যায়, ততোদূর দৃষ্টি জুড়ায় সমতল ভূমির সবুজ চা পাতার দৃশ্য। পর্যটকদের জন্য এ বাগানগুলো হয়ে উঠতে পারে আনন্দ ও উপভোগ্যের। মন জুড়িয়ে দিবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।

শতশত বছরের প্রাচীন স্থাপনা, প্রত্নতত্ত্ব দূর্গনগরী, বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট, চারদেশীয় স্থলবন্দর, ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট, রক্স মিউজিয়াম, প্রায় অর্ধ-শতাধিক নদ-নদী, গ্রামীণ জীবনের মানুষের সরল জীবনাচার পর্যটনে অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

প্রাচীন নির্দশনের বিভিন্ন স্থাপনা, প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা, সরকারি-বেসরকারিভাবে গড়ে উঠা বিভিন্ন স্থাপনা, গ্রামীণ সংস্কৃতি ও দৃষ্টিনন্দন জীবনাচারে এ অঞ্চলটি হয়ে উঠেছে পর্যটন অঞ্চল হিসেবে। সুদীর্ঘকাল ধরে দেখা মিলছে পৃথিবীর ২ পর্বতশৃঙ্গ হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা।

ভোরের সতেজ শিশির ভেজা চা বাগানে দাঁড়িয়ে এক কাপ চায়ের চুমুকে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা-হিমালয়ের মনোমুগ্ধকর রূপ দেখার মধ্য দিয়ে সমতলের চা বাগান বাড়িয়ে দিয়েছে টি ট্যুরিজমের বহুমাত্রিক গুরুত্ব। 

চা বাগান ঘুরে আল ইমরান, মোতাহের হোসেন ইমরান খানসহ কয়েকজন পর্যটক জানান, এ অঞ্চলে টি ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সমতল ভূমিতেও যে চা বাগান হতে পারে তা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় না আসলে বুঝতে পারতাম না। সিলেট বা শ্রীমঙ্গলের মতো টি ট্যুরিজমের যথেষ্ঠ সম্ভাবনা রয়েছে। এসব বাগানগুলোতে রিসোর্ট গড়ে তুলতে পারলে পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনা তৈরি করবে বলে মনে করছি।

তেঁতুলিয়া টি ভ্যালি গ্রিন রিসোর্টের শহীদুল ইসলাম জানান, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় আমরা ৪ জন কালান্দিগঞ্জ এশিয়ান মহাসড়কের ধারে চা বাগানের সামনে টি ভ্যালি গ্রিন রিসোর্ট নির্মাণ করছি। কাজ চলমান রয়েছে। এখানে পর্যটকরা এসে রাত যাপন থেকে শুরু করে এখানকার পর্যটন স্পটগুলোর দেখার পাশাপাশি সমতলে চা বাগানের অপরুপ সবুজায়ন দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।

তেঁতুলিয়া ট্রাভেল এন্ড ট্যুরিজম পর্যটক সেবা প্রতিষ্ঠানটি জানান, সিলেটের মৌলভীবাজারের মতো উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি এখানকার দিগন্তজুড়ে সমতলের বুকে সবুজ চা বাগান পর্যটক আকৃষ্ট করছে। এতে টি ট্যুরিজমের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। চা বাগানগুলোতে যদি রিসোর্ট গড়ে তোলা যায়, তাহলে পর্যটকদের সমাগম আরও বৃদ্ধি পাবে।

উপমহাদেশের অন্যতম পর্যটনবিদ ও প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির পর্যটন বিভাগের প্রধান ড.এ আর খান বলেন, উত্তরবঙ্গে পঞ্চগড় চা শিল্পে তৃতীয় অঞ্চল হয়ে উঠায় টি ট্যুরিজমের প্রচুর সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এখানকার চা-বাগানগুলো পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত মনোরম ও উপভোগ্য। বাগানগুলোতে যদি পর্যটকদের জন্য বিশেষ রিসোর্ট, হোটেল ও বাংলো গড়ে তোলা যায়, তাহলে পর্যটন শিল্পে যুক্ত হবে নতুনমাত্রা।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দ্বার এখন উত্তরের সীমান্তজেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। এখানকার সবুজ চা বাগান সিলেট-চট্টগ্রামের মতো পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ছে। এখানে বাগানগুলোতে চা পাতা কাটা, ফ্যাক্টরিগুলোতে চা প্রক্রিয়াকরণ আর স্থানীয়ভাবে চা পাওয়া যাচ্ছে তা, পর্যটন শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এখানকার কাজী এন্ড কাজী, ডাহুক টি রিসোর্ট ও সম্প্রতি তেঁতুলিয়া কালান্দিগঞ্জে চা বাগানে গড়ে উঠেছে টি ভ্যালি গ্রিন রিসোর্ট, যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। আমরা প্রশাসনিকভাবে চেষ্টা করবো এখানকার বড় বড় চা বাগানের মালিকদের সাথে টি ট্যুরিজমের বিষয়টি জানিয়ে উদ্যোগী করে তুলতে।