জাতীয় নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক ফেরদৌসি আক্তার সোনালী। অতিদারিদ্র পরিবারের মেয়ে। ভ্যানচালক বাবার ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের মধ্যে বেড়ে ওঠা সোনালী সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে।
গত ১৫ আগস্টে গ্রামের বাড়িতে এলে সোনালীকে নিয়ে ‘আমি ভ্যান চালাই, আমার মেয়ে বিমানে চড়ে দেশ-বিদেশে খেলতে যায়’- এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হলে নজরে আসে জেলা প্রশাসকের।
বলছিলাম পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের বনগ্রামের ফারুক ইসলামের মেয়ে সোনালীর কথাই। গোলরক্ষক সোনালীর পরিবারের গল্প নিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি নজরে এলে জেলা প্রশাসক সাবেত আলী তাদের খোঁজখবর নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেন।
পরে গত ২৫ আগস্ট ফারুক ইসলামের বাড়িতে পরিদর্শনে গিয়ে বিশেষ সুবিধা সম্পন্ন দৃষ্টিনন্দন পাকা ঘর এবং উপার্জনের ভ্যানের বদলে নতুন ইজিবাইক কিনে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক সাবেত আলী।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ফারুক ইসলামের হাতে ইজিবাইকের চাবি হস্তান্তর করেছেন জেলা প্রশাসক মো. সাবেত আলী।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সুমন চন্দ্র দাস, সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট আমিনুল হক তারেক ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকালীন সমন্বয়ক ফজলে রাব্বী প্রমুখ।
জানা যায়, সোনালীর ফুটবল খেলা শুরু হয় স্থানীয় গইচপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেই। এরপর হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াকালীন আন্তঃবিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে নজরে আসেন তিনি। সেখান থেকেই ভর্তি হন পঞ্চগড়ের টুকু ফুটবল একাডেমিতে। ২০২৩ সালে মেলে বড় সুযোগ বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি হন।
লাওসে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-২০ নারী এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব শেষে গ্রামে এলে পরিবার-আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। সোনালীর সাফল্যে আপ্লুত হয়ে বাবা ফারুক ইসলাম মিষ্টি বিতরণ করেন এলাকায়। বর্তমানে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোনালী জাতীয় দলের পাশাপাশি বিকেএসপিতে গোলরক্ষক হিসেবে নিয়মিত অনুশীলন করছেন।
গ্রামে এসে সোনালী বলেছিলেন, বিকেএসপিতে থাকতেই জাতীয় দলে ডাক পাই। পরে সিনিয়র দলের হয়ে জর্ডানে খেলেছি, যেখানে আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। অনূর্ধ্ব-২০ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপেও শিরোপা জিতেছি। সর্বশেষ লাওসে অনুষ্ঠিত এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়ান কাপে রানার্স আপ হয়েছি।
সোনালির মা মেরিনা বেগম জানান, মেয়েকে খুবই কষ্ট করে অনুশীলনে পাঠিয়েছি। কখনো কখনো টাকার অভাবে যেতে পারেনি, তবুও হাল ছাড়েনি। আজ জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছে, এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি।
প্রতিবন্ধকতা জয় করে মেয়ের গর্বে আত্মহারা তিনি। এ সময় জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে ইজিবাইক পেয়ে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
বাবা ফারুক ইসলাম জানান, সম্পত্তি তেমন নেই। পুরোনো ব্যাটারিচালিত ভ্যান আর ঘরের জায়গাটুকু সম্বল। ভ্যান চালিয়েই সংসার চালান। দরিদ্রতা নিয়েই বড় করেছেন ৩ সন্তানকে। মেয়ের ফুটবল খেলায় বাধা দেননি কখনো। কষ্ট করে হলেও পাশে থেকেছেন।
মেয়ের এমন জয়ে গর্ব করে সেদিন বলেছিলেন, আমি ভ্যান চালাই, আমার মেয়ে বিমানে চড়ে দেশ-বিদেশে খেলতে যায়’ এটাই আমার গর্ব।
টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, সোনালী অনেক মেধাবী ও পরিশ্রমী। তার উপর একটা ভরসা ছিল যে, সে জাতীয় দলে জায়গা করে নেবে। আমার আশা পূর্ণ হয়েছে। সোনালী পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান তিনি।