বিশ্ব পর্যটন দিবস

এক দশকে বদলে যাওয়া তেঁতুলিয়া

সীমান্তের নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। ত্রি-সীমান্তের কোলে উত্তরের ছোট্ট উপজেলাটি হয়ে উঠেছে দেশের সর্বাধিক পরিচিতি স্থানের একটি, যা দুই বঙ্গের পর্যটকদের কাছে আকর্ষিত এলাকা। ভারত-নেপালের সীমান্তে পৃথিবীর ২ সুউচ্চ পর্বতমালা হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মেলে তেঁতুলিয়া থেকেই।

২ বাংলার বুক চিরে প্রবাহিত নদী মহানন্দার তীরে দাঁড়িয়েই শরতের শুভ্রতায় মেঘমুক্ত আকাশে সৌন্দর্যের বিলাস ছড়াচ্ছে চোখ জুড়ানো পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত হিমালয় ও কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ-মাধুর্য। বিনা পাসপোর্ট ও ভিসায় কাছ থেকে হিমালয়-কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার সুযোগ দেশের অন্য কোথাও নেই। তাই তো বিনা পাসপোর্ট ভিসায় দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে দুই পর্বতযুগলের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের কারণে অঞ্চলটি পরিচিতি পেয়েছে হিমালয়কন্যা হিসেবে।

গত এক দশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবেও বদলে গেছে পঞ্চগড়ের চিত্র। পর্যটন শিল্প উন্নয়নে প্রশাসনিকভাবে গৃহিত প্রকল্পের বাস্তবায়নে সমৃদ্ধ করেছে পর্যটন শিল্পকে। তেঁতুলিয়ার উপজেলা প্রশাসনের তৎকালিন নির্বাহী কর্মকর্তা সানিউল ফেরদৌস ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল করিম শাহিনের হাত ধরে তেঁতুলিয়ার পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের ছোয়া লাগে। ওই সময়ে বদলে যায় তেঁতুলিয়ার জেলা পরিষদ ডাকবাংলোর পিকনিক কর্নার।

পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণে আধুনিক ও যুগোপোযোগী পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সৌন্দর্য বর্ধনে নির্মাণ করা হয় বিভিন্ন কৃত্রিম ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস, ঐতিহ্যে প্রতিকৃতি নির্মাণ করা হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার মোহনীয় দৃশ্য দেখার জন্য ওয়াচ টাওয়ার। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে তৈরি করা হয়েছে কমিউনিটি বেরং কমপ্লেক্স, ডাইনিং রুম, বেঞ্চ ও দোলনা নির্মাণ, স্ট্রিট লাইট স্থাপন, ঝরণা ফোয়ারা, বাউন্ডারি ওয়াল, সুদৃশ্য গেট, অভ্যন্তরীণ ও চারপাশে এইচবিবি রাস্তা এবং গাইড ওয়াল নির্মাণ করা হয়। ডাকবাংলোয় সংযুক্ত বন বিভাগে নির্মিত হয়েছে ইকোপার্ক। পরবর্তীতে ইউএনও সোহাগ চন্দ্র সাহার হাত ধরে পর্যটন উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হয়।

বর্তমান তেঁতুলিয়ার ইউএনও আফরোজ শাহিন খসরু পর্যটন উন্নয়নে নিয়েছেন বিভিন্ন পরিকল্পনা। পর্যটন উন্নয়ন বাস্তবায়িত ও চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে দেশের একমাত্র চারদেশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধার জিরোপয়েন্ট এলাকায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উঁচু পতাকা স্ট্যান্ড স্থাপন করা হয়েছে। এ স্ট্যান্ডে সার্বক্ষণিক উড়বে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।

তেঁতুলিয়া পুরাতন বাজারে পর্যটক, শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে মহানন্দা পার্ক স্থাপন এবং পিকনিক কর্নারের উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে। এ মহানন্দা পার্ক হতে ডাকবাংলো পর্যন্ত পর্যটকদের বিনোদনের জন্য মহানন্দা নদীর তীর ঘেষে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে নির্মাণ। এ ওয়াকওয়ে ব্যবহার করে ডাকবাংলো থেকে পুরাতন বাজার মহানন্দা পার্ক হেঁটে হেঁটে সীমান্ত প্রবাহিত মহানন্দা নদীর এপার-ওপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন পর্যটকরা। এছাড়াও তেঁতুলিয়া চৌরাস্তাা বাজার, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও তৎসংলগ্ন এলাকা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য গারবেজ পিট নির্মাণ, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর সংলগ্ন জিরো পয়েন্ট এলাকায় বাংলাদেশ গেট নির্মাণ, পর্যটকদের বসার জন্য শেড নির্মাণ এবং স্ট্রীট লাইট স্থাপন, পিকনিক কর্নারে পর্যটকদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, ভাস্কর্য স্থাপন, ডাকবাংলো পর্যন্ত স্ট্রিট লাইট স্থাপনের কাজের চলমান রয়েছে।

এদিকে পর্যটকদের সুবিধার্থে তেঁতুলিয়ার সব আবাসিক হোটেলসমূহকে নিয়ে একটি অনলাইন হোটেল ম্যানেজমেন্ট ওয়েব এপ্লিকেশন তৈরির কাজ চলমান রয়েছে জানিয়েছে উপজেলা প্রশাসন। কাজগুলো শেষ হলে নতুনমাত্রা যোগ হবে পর্যটন শিল্পে।

ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে পর্যটন শিল্পে সমৃদ্ধ করেছে দেশের ভিন্নমাত্রিক স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা। পর্যটকদের অপার আগ্রহ ‘জিরোপয়েন্ট’। এই জিরোপয়েন্টে স্থাপিত হয়েছে চারদেশীয় (বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান) ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটনে অপার সম্ভাবনা। এ ইমিগ্রেশন ব্যবহার করে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং, ডুয়ার্সসহ ভুটান ও নেপাল ভ্রমণ করছে অতি সহজেই। তাই ভারত বাংলাদেশের মধ্যে যতগুলো স্থলবন্দর রয়েছে, ভারতীয় পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির মতো এত বড় সমৃদ্ধ শহর আর নেই। এ বন্দর হতে শিলিগুড়ির দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। ভারতের শৈল্যশহর শহর দার্জিলিং, হিমালয় পর্বতচূড়ার কাঞ্চনজঙ্ঘা মাত্র ৮৫ কিলোমিটার। এ বন্দরের ইমিগ্রেশনের চালুর পর থেকে ভ্রমণ করছেন প্রচুর দেশি-বিদেশি পর্যটক।

পর্যটনের দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও চিকিৎসা। বন্দর সংশ্লিষ্ট নেপাল ও ভুটানসহ অন্যান্য দেশে এ স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করেন শিক্ষার্থীরা। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরাও শিলিগুড়ি, দার্জিলিংসহ বিভিন্ন স্থানে পড়াশোনা করতে এ বন্দর ব্যবহার করে থাকেন। চিকিৎসা সেবা নিতে বাংলাদেশিরা বেঙ্গালোর, চেন্নাই, মুম্বাই, কলকাতা যেতে এ স্থলবন্দর ব্যবহার করে খুবই অল্প সময়ে ভারতে প্রবেশ করে শিলিগুড়িতে অবস্থান করেন। সেখানে বিমানবন্দর, রেলওয়ে জংশন এবং সড়ক যোগাযোগ ভালো থাকায় পর্যটনে ব্যাপক সম্ভাবনা এ স্থলবন্দর। ব্যবসা-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার সাথে ইমিগ্রেশন সুবিধা চালু হওয়ায় বাড়িয়ে দিয়েছে পর্যটন শিল্পের নতুনমাত্রা। তবে বর্তমানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে প্রতিবেশি দেশ ভারত ট্যুরিস্ট ভিসা বন্ধ রাখায় ইমিগ্রেশনে যাত্রীপারাপারে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। সমস্যা নিরসন ঘটলে আবার কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে ইমিগ্রেশনটি।

আরেকদিকে পর্যটন শিল্পে সমৃদ্ধ করেছে সমতলের ভূমিজুড়ে সবুজ চা বাগান। সবুজের বুকে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দৃশ্য উপভোগ যেন তেঁতুলিয়াতেই। দেড় দশক ধরে সবুজ চা বাগান ঘিরে এখন অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে টি ট্যুরিজমে। পাথর ও চা শিল্প ঘিরে যেমন অর্থনীতিতে বদলে গেছে এ অঞ্চল। পর্যটনেও তেঁতুলিয়ার ২০ কিলোমিটার জুড়ে মহানন্দা নদীর বুকে দলবাধা শ্রমিকদের পাথর উত্তোলনের দৃশ্যও পর্যটকদের মুগ্ধ করছে। অনেকে গবেষণা, নাটক ও সিনেমা তৈরিতেও বেছে নিয়েছেন পর্যটনের এ অঞ্চলটি। ইকো ট্যুরিজম গড়ে উঠতে শুরু করেছে এ অঞ্চলটিতে। পর্যটন শিল্প ঘিরে গত এক দশকে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু আবাসিক হোটেল রেস্তোরা, পর্যটক সেবা প্রতিষ্ঠান। 

পর্যটকদের নিরাপত্তা প্রদানে প্রশাসন, থানা পুলিশের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন ট্যুরিস্ট পুলিশ। ২০২০ সালে তেঁতুলিয়ায় স্থাপিত হয় ট্যুরিস্ট পুলিশ জোন। থানাটি স্থাপিত হওয়ার পর থেকে ডাকবাংলোসহ পর্যটন স্পটগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ট্যুরিস্ট পুলিশের নিরাপত্তাসহ যেকোনো সেবা গ্রহণ করতে বিলবোর্ডে ট্যুরিস্ট পুলিশের সেবা নম্বর উল্লেখ করেছেন।

ট্যুরিস্ট পুলিশের পরিদর্শক কে এম আজমিরুজ্জামান জানান, দেশের পর্যটনের অন্যতম অঞ্চল হচ্ছে উত্তরের পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। আমরা পর্যটকদের জন্য সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছি। আমাদের কন্টাক্ট নম্বরগুলো বিভিন্ন জায়গায় বিল বোর্ডেও প্রদর্শন করেছি। যাতে যেকোনো প্রয়োজনে পর্যটকরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। জরুরি ফোন এলে আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। 

তেঁতুলিয়ার পর্যটন উন্নয়ন প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আফরোজ শাহীন খসরু বলেন, দেশের উত্তরের জেলাগুলোর মধ্যে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা পর্যটন শিল্পের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনিকভাবে পর্যটনে উন্নয়নে আমরা বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছি। বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্টে পতাকা স্ট্যান্ড নির্মাণ, লাইট, গেট, মহানন্দা পার্ক উন্নয়নে কাজ চলমান, মহানন্দা পার্ক হতে ডাকবাংলো পিকনিক কর্নার পর্যন্ত মহানন্দা নদীর তীর ঘেষে ওয়াক ওয়ে (রাস্তা) নির্মাণ করাসহ অনেকগুলো কাজ করা হচ্ছে, যা পর্যটকদের মুগ্ধ করবে। পাশাপাশি পর্যটকদের আবাসন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রয়েছে।