এশিয়া মহাদেশের মধ্যে থাইল্যান্ড উচ্চশিক্ষার অনন্য গন্তব্য। প্রধান ভাষা থাই হলেও প্রায় সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ইংরেজি প্রোগ্রাম চালু থাকায় বিদেশি শিক্ষার্থীরা সহজেই মানিয়ে নিতে পারেন। থাইল্যান্ডে উচ্চশিক্ষায় আবেদন, স্টুডেন্ট ভিসা, অধ্যয়ন খরচ ও স্কলারশিপ নিয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
সেরা বিশ্ববিদ্যালয়— মাহিদোল ইউনিভার্সিটি, চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটি, চিয়াং মাই ইউনিভার্সিটি, থাম্মাসাত বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাসেতসার্ত ইউনিভার্সিটি, প্রিন্স অব সংক্লা ইউনিভার্সিটি, খন ক্যায়েন ইউনিভার্সিটি প্রভৃতি।
সর্বাধিক চাহিদাসম্পন্ন বিষয় — ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ স্টাডিজ, বিজনেস স্টাডিজ, জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি, সোশ্যাল সায়েন্স ও ন্যাচারাল সায়েন্স।
আবেদনের উপায়— সাধারণত দুটি মৌসুমকে কেন্দ্র করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ভর্তির কার্যক্রম চলে। একটি হচ্ছে অটাম, যার জন্য আবেদন গ্রহণ শুরু হয় মে মাস থেকে। জুলাই নাগাদ সব আবেদন নেওয়া শেষ করে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করা হয় আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে।
ভর্তির দ্বিতীয় ইনটেকটি স্প্রিং। ভর্তি শুরু হয় যায় জানুয়ারিতে। এর জন্য আবেদনের সময় থাকে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি। ক্লাস শুরু হতে হতে মার্চ চলে আসে।
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় ক্ষেত্রেই এ ইনটেকগুলো বজায় রাখা হয়। তবে মৌসুমের এই ভিন্নতা মূলত প্রোগ্রামের ওপর নির্ভর করে। এমন অনেক প্রোগ্রাম আছে, যেগুলোর জন্য শুধু একটি মৌসুমেই আবেদন নেওয়া হয়।
তাই সর্বোত্তম পন্থা হলো সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। এতে যে শুধু নির্দিষ্ট প্রোগ্রাম সম্পর্কেই আপ-টু-ডেট থাকা যায়, তা নয়। পাশাপাশি ওপরে উল্লিখিত সাধারণ ইনটেকের বাইরে ভর্তির বিষয়েও জানা যায়। এ যোগাযোগের জন্য সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট চেক করা যেতে পারে। ভর্তির প্রক্রিয়াগুলো পরিচালিত হয় থাই ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল অ্যাডমিশন সিস্টেম বা থাইল্যান্ডের কাউন্সিল অব ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্টস-এর মাধ্যমে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র—
সম্পূর্ণরূপে পূরণ করা ভর্তির আবেদনপত্র
হাইস্কুল ডিপ্লোমা (স্নাতকের জন্য)
ব্যাচেলর ডিপ্লোমা (মাস্টার্সের ক্ষেত্রে)
একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট
ইংরেজি দক্ষতার প্রমাণ: আইইএলটিএস স্কোর ন্যূনতম ৫ দশমিক ৫, টোয়েফলে সর্বনিম্ন ৬০, পিটিই একাডেমিকে কমপক্ষে ৪৩
অধ্যয়নকালে থাইল্যান্ডে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সামর্থ্যের প্রমাণ
* মেডিকেল সার্টিফিকেট
* সদ্য তোলা পাসপোর্ট আকারের ছবি
* বৈধ পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র
* একাধিক রিকমেন্ডেশন লেটার
* পারসোনাল স্টেটমেন্ট
* আবেদন ফি প্রদানের প্রমাণ (যদি থাকে)
আবেদন পরবর্তী প্রক্রিয়া
সাধারণত আবেদন জমা দেওয়ার পর যাবতীয় কাগজপত্র যাচাই করতে ১ থেকে ৩ কর্মদিবস সময় লাগে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসহ ই-মেইলের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে করণীয় জরুরি নির্দেশনা দেওয়া হয় আবেদনকারীকে। মূলত ১০ দিনের মধ্যে আবেদন ফি পরিশোধ করতে বলা হয়। এরপর অধ্যয়ন ফির জন্য ইনভয়েস ই-মেইল করা হয়। সাধারণত সেমিস্টার শুরু হওয়ার প্রায় আড়াই মাস আগে অধ্যয়ন ফির চালান সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এই ফি দেওয়ার পরপরই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিপত্র (অফার লেটার) পাঠানো হয়।
স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন
‘নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা টাইপ ইডি প্লাস’। এটিই হচ্ছে থাইল্যান্ডের স্টুডেন্ট ভিসা, যার মেয়াদ থাকে সিঙ্গেল এন্ট্রিতে ইস্যুর দিন থেকে সর্বোচ্চ ৩ মাস বা ৯০ দিন। এই ভিসার আবেদনের পূর্বশর্তগুলো হলো—
* একটি থাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ভর্তির অফার লেটার
* ন্যূনতম তিনটি কোর্স নেওয়া (কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে চারটি)
* প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫ ঘণ্টা ক্লাস থাকে, এমন কোর্স নেওয়া
* অবশ্য ব্যাচেলর বা তার ওপরের পর্যায়ের যেকোনো দীর্ঘকালীন প্রোগ্রামগুলোয় ভর্তি হলে উপরোক্ত সব কটি শর্তই পূরণ হয়ে যায়।
* ভিসার তিন মাস মেয়াদ স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের সময়ের জন্য যথেষ্ট নয়। তাই এই ভিসা নিয়ে থাইল্যান্ড যাওয়ার পর ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া যায়। শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর পক্ষ থেকে ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করতে পারে।
* ‘নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা টাইপ ইডি প্লাস’-এর আবেদন ফরমটি এই লিংক থেকে ডাউনলোড করা যাবে।
এটি পূরণ করে প্রিন্ট নিতে হবে। ফরমের নির্ধারিত স্থানে স্বহস্তে স্বাক্ষর করে জমা দেওয়ার জন্য অন্য দরকারি নথিপত্রের সঙ্গে সংরক্ষণ করতে হবে।
ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র— সম্পূর্ণরূপে পূরণ করা এবং স্বহস্তে স্বাক্ষরকৃত স্টুডেন্ট ভিসা আবেদনপত্র (স্বাক্ষর অবশ্যই পাসপোর্টের স্বাক্ষরের অনুরূপ হতে হবে)
থাইল্যান্ডে পৌঁছার দিন থেকে আরও ছয় মাসের মেয়াদ থাকা বৈধ পাসপোর্ট (তাতে অবশ্যই ন্যূনতম দুটি ফাঁকা পৃষ্ঠা থাকতে হবে)। পূর্বে কোনো ভিসা পেয়ে থাকলে পাসপোর্টের সেই পৃষ্ঠাগুলোর ফটোকপি
পুরোনো পাসপোর্ট (যদি থাকে)
* থাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীর ভর্তির বিস্তারিত তথ্যসহ অফার লেটার। তার সঙ্গে ইস্যুকারী ব্যক্তির আইডি কার্ড ও পাসপোর্টের অনুলিপি থাকতে হবে।
* শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেসরকারি হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন নিতে হবে।
* একটি পাসপোর্ট সাইজ (৩ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার x ৪ দশমিক ৫ সেন্টিমিটার) ছবি: সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে তুলতে হবে এবং ছবি ছয় মাসের বেশি পুরোনো হওয়া যাবে না।
আর্থিক সচ্ছলতার সপক্ষে প্রমাণপত্র: শুধু শিক্ষার্থীর জন্য কমপক্ষে ২০ হাজার থাই বাথ (১ থাই বাথ = ৩ দশমিক ৭১ বাংলাদেশি টাকা)। পরিবারসহ আবেদনের ক্ষেত্রে ৪০ হাজার বাথ বা ১ লাখ ৪৮ হাজার ২৫১ টাকা।
*সন্তোষজনক লেনদেনসহ বিগত ছয় মাসের ব্যাংক স্টেটমেন্ট
* ব্যাংক থেকে ইস্যু করা ব্যাংক সলভেন্সি লেটার
* শিক্ষার্থীকে যদি তাঁর কোম্পানির পক্ষ থেকে স্পনসর করা হয়, তাহলে কোম্পানির ট্রেড লাইসেন্স, ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও ব্যাংক সলভেন্সি লেটার
* প্লেনের টিকিট বুকিংয়ের নথিপত্র
* থাইল্যান্ড গমনের উদ্দেশ্য উল্লেখপূর্বক প্রার্থীর (বা তাঁর স্পনসরের) পক্ষ থেকে ভিসা অনুরোধপত্র
* পূর্ববর্তী একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স থেকে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হতে হবে
* পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট
* ইংরেজি দক্ষতা সার্টিফিকেট (আইইএলটিএস/টোয়েফল/পিটিইর নথিপত্র)
* ভিসা ফি রসিদ
এগুলোর কোনো একটি নথি বাংলা ভাষায় থাকলে তা অবশ্যই জাতীয়ভাবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিতে হবে।
ভিসা আবেদন জমা
থাইল্যান্ডের স্টুডেন্ট ভিসার কাগজপত্র জমার কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিংয়ের দরকার নেই। নির্দিষ্ট সময় জেনে যেকোনো কর্মদিবসে সশরীর বা নিজের কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে কাগজপত্র জমা দেওয়া যাবে। বাংলাদেশে থাই দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাদের গ্লোবাল পার্টনার ভিএফএস (ভিসা ফ্যাসিলিটেশন সার্ভিসেস) আবেদন গ্রহণ করে থাকে। রাজধানী ঢাকাসহ ভিএফএস সেন্টার রয়েছে চট্টগ্রাম ও সিলেটে।
* ঢাকার ভিএফএস ঠিকানা: বোরাক মেহনুর ৫১/বি, ৮ম তলা, কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ, বনানী-১২১৩।
* চট্টগ্রাম ভিএফএস ঠিকানা: ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার চট্টগ্রাম, (৫ম তলা) ১০২/১০৩ আগ্রাবাদ সিএ, কমার্স কলেজ রোড, চট্টগ্রাম-৪১০০।
* সিলেট ভিএফএস ঠিকানা: মার্চেন্ট টাওয়ার (লেভেল-৪), পূর্ব মিরাবাজার, সিলেট-৩১০০।
এগুলোর যেকোনোটিতে ভিসার সমুদয় কাগজপত্র জমা দিতে রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে উপস্থিত হতে হবে। এই দিন নথিপত্র গ্রহণ করার পর আবেদনকারীকে আবেদন গ্রহণের স্বীকৃতিস্বরূপ একটি রসিদ প্রদান করা হবে। এটি পরবর্তী সময়ে ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট গ্রহণের সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসতে হবে।
ভিসা প্রক্রিয়াকরণের সময় ও আনুষঙ্গিক খরচ—
‘নন-ইমিগ্র্যান্ট ভিসা টাইপ ইডি প্লাস’-এর প্রক্রিয়াকরণের সময় সাধারণত ৩ থেকে ৫ সপ্তাহ। এর মধ্যে অনলাইনে ভিসা আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে। এই পরিষেবাটি পেতে এই লিংকে যেতে হবে।
এখানে দরকার হবে আবেদনকারীর জন্মতারিখ এবং একটি রেফারেন্স নম্বর, যেটি পাওয়া যাবে ভিএফএস থেকে প্রদান করা সেই রসিদে।
ভিসা আবেদনের ফি ভিএফএস সেন্টারে আবেদন জমা দেওয়ার সময় সংলগ্ন ব্যাংক কাউন্টারে নগদ জমা করতে হবে। থাই দূতাবাসের ভিএফএস সাইট অনুসারে, এই ভিসা ফি সাত হাজার টাকা। এর সঙ্গে অতিরিক্ত রয়েছে ভিএফএস সার্ভিস চার্জ এক হাজার টাকা ও ব্যাংক ফি ৬০ টাকা।
পড়াশোনার সম্ভাব্য খরচ
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অধ্যয়নের বিষয় ও প্রোগ্রামের ওপর ভিত্তি করে পড়াশোনার খরচের মধ্যে যথেষ্ট ভিন্নতা থাকে। স্বল্প বাজেটের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গড়পড়তায় খরচ হতে পারে সর্বনিম্ন ৬০ থেকে ৯০ হাজার বাথ পর্যন্ত। ব্যয়বহুল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়ার জন্য বাজেট রাখতে হবে ১ লাখ ১২ হাজার থেকে ১ লাখ ৭৫ হাজার বাথ।
সরকারি, বেসরকারি ও স্থানীয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থাইল্যান্ডে আসা আন্তর্জাতিক ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে। এমওপিএর (থাই মিনিস্ট্রি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) অফিশিয়াল সাইট মতে, ইনবাউন্ড এক্সচেঞ্জ স্কলারশিপের মূল্যমান ৩০ হাজার থাই বাথ। এটি মূলত খোন কাইন ইউনিভার্সিটির প্রকল্প, যেটি দেওয়া হয় শুধু বিবিএ, বিএ ও ব্যাচেলর অব কমিউনিকেশন আর্টসের শিক্ষার্থীদের। স্কলারশিপ রোয়ারের তথ্যানুসারে, থাইল্যান্ড গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ বিস্তৃত পরিসরে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে।
খণ্ডকালীন চাকরি— থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে সর্বোচ্চ ২০ ঘণ্টা খণ্ডকালীন কাজ করার অনুমতি দেওয়া হয়। অতিরিক্ত উপার্জনের জন্য সামার ভ্যাকেশনসহ বিভিন্ন উৎসব ও সপ্তাহান্তগুলো বেছে নেওয়া যায়। কেননা, এ সময়গুলোয় কর্মঘণ্টার কোনো সুস্পষ্ট সীমাবদ্ধতা থাকে না বিধায় ফুলটাইম কাজ করা যায়। তথ্যসূত্র: ইউএনবি