হার্ভার্ডসহ ১০ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমানের

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সালমান চৌধুরী। নামটি আপনার কাছে আনকোরা কোনো নাম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীর এই সন্তান পড়াশোনার জন্য জায়গা করে নিয়েছে অসংখ্য গণমাধ্যমের পাতায়। আইভি লিগের হার্ভার্ড–ইয়েলসহ সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। কোনো কোনোটা থেকে পেয়েছেন ফুলফান্ডেড বৃত্তি। এরপরই থেকেই আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি। কারণ, কোনো দামি কোচিংয়ে তিনি যাননি, কোনো অ্যাডমিশন কনসালট্যান্টের সহায়তা নেননি, নিজ চেষ্টায় পরিবারকেন্দ্রিক মূল্যবোধকে সম্বল করে তিনি পৌঁছেছেন স্বপ্নের ঠিকানায়।

সালমান চৌধুরী সম্প্রতি নিউ জার্সির প্যাসিফিত কাউন্টি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (পিসিটিআই) স্টেম একাডেমি থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। এরই মধ্যে হার্ভার্ড, ইয়েল, প্রিন্সটন, কলাম্বিয়া, পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ আইভি লিগসহ ১০টি শীর্ষ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।

আইভি লিগ মানেই আভিজাত্য, যোগ্যতা, মেধা আর মননশীল সুস্থ উন্নত মানুষের সংমিশ্রণে আমেরিকার শিক্ষাঙ্গনের ধারণা। ৮টি আইভি লিগ বিশ্ববিদ্যালয় হলো ব্রাউন ইউনিভার্সিটি, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, কর্নেল ইউনিভার্সিটি, ডার্টমাউথ কলেজ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়া ও ইয়েল ইউনিভার্সিটি।

সিএনবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, মাত্র তিনটি সহজ সূত্রে হার্ভার্ড, ইয়েল, প্রিন্সটনসহ সেরা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন সালমান চৌধুরী। সিএনবিসির ‘ইয়াং সাকসেস’ সিরিজে সালমান চৌধুরী তার নিজের যাত্রাপথ তুলে ধরে ধরেছেন। সেখানে তিনি তার মা-বাবার করা তিনটি কাজই যে সবকিছু বদলে দিয়েছে, তা তুলে ধরেছেন। সেগুলো হলো—

ঘুম, খাবার এবং স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিতেন মা–বাবা

গবেষণায় ধারাবাহিকভাবে দেখা গেছে যে ভালো ঘুম এবং সঠিক পুষ্টি একাডেমিক পারফরম্যান্সকে ভালো বা উন্নত করে। আমার বাবা-মা এটা গুরুত্বসহকারে নিয়েছিলেন। তারা ঘরে একটি স্থির পরিবেশে যেন আমি বড় হই, তা নিশ্চিত করেছেন। পরিশ্রমের আগে তারা আমার স্বাস্থ্যের গুরুত্ব দিতেন। আমি যেন পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাই, তা নিশ্চিত করতে বাবা প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাকে আগে স্কুলে নিয়ে যেতেন, এরপর কাজে মানে অফিসে যেতেন। স্কুল বাসে ধরে যেতে হতো না বলে আমি অতিরিক্ত এক ঘণ্টা ঘুমাতে পারতাম। একইভাবে আমার মা সূর্যোদয়ের আগে ঘুম থেকে উঠতেন, কখনো কখনো ভোর সাড়ে ৪টায় উঠে আমার জন্য পুষ্টিকর নাশতা তৈরি করেন। নাশতায় মা আমার জন্য দুটি ডিম, গারলিক টোস্ট (রসুন দিয়ের টোস্ট) ও প্রোটিনসমৃদ্ধ প্রাতরাশ তৈরি করতেন। আমার বাবা-মা তাঁদের অফিসে কাজের সময়সূচি এমনভাবে ম্যানেজ করতেন, যাতে আমি কখনোই বাড়িতে এসে একা না থাকি। আমার স্কুল শেষ হওয়ার সাথে সাথেই তারাও বাড়ি ফিরে আসতেন।

বাবা–মা আমাকে নানা সুযোগ খুঁজতে উৎসাহিত করতেন

সালমান স্বীকার করেন, তিনি স্কুলজীবনের শুরুতে শুধু গ্রেডের দিকে মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু তার মা-বাবা তাকে উৎসাহ দেন বিভিন্ন ক্লাব, প্রতিযোগিতা, টিমে অংশ নিতে। এই উৎসাহই তাঁর সামনে নানা সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল ‘আউটলিয়ার্স’-এ বলেছেন যে সাফল্যের জন্য কেবল প্রতিভা এবং কঠোর পরিশ্রমই যথেষ্ট নয় বরং নিজস্ব আগ্রহ বিকাশের সুযোগও খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এ কথাটি আমার মনে গেঁথে গেছে। হাইস্কুলের শুরুতে আমি শিক্ষার প্রতি খুব বেশি মনোযোগী ছিলাম। আমার বাবা-মাও আমাকে বিভিন্ন ক্লাবে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছিলেন। যদি আমি ক্লাবে যোগ দেওয়া পছন্দ না করতাম তাহলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারতাম না। আমার অভিবাসী বাবা-মা পাঠ্যক্রমবহির্ভূত শিক্ষা কার্যক্রমের সুযোগ পাননি বা ছিল না তাদের। আমাকে তারা মনে করিয়ে দেন, এ ব্যাপারে আমি কতটা ভাগ্যবান।

এরপরই ওই সময় আমি সবচেয়ে বেশি পাঠ্যক্রমবহির্ভূত শিক্ষা কার্যক্রম, মানে বিভিন্ন ক্লাবে জড়িত শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন হয়েছিলাম এবং আশ্চর্যজনকভাবে অনেক মজা পেয়েছিলাম এসব কাজে। আমি রোবোটিকস, ফিউচার বিজনেস লিডার্স অব আমেরিকা (এফবিএলএ) এবং স্কিলসইউএসএ-তে অংশগ্রহণ করেছি। এমনকি আমি বাস্তব-বিশ্বের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পগুলোতেও কাজ করেছি, যেমন স্কুলভিত্তিক উদ্যোগের জন্য গণিত মডেল অপ্টিমাইজ করা।

আমার অন্যতম গর্বের কৃতিত্ব হচ্ছে নাসা হাঞ্চ (NASA HUNCH) টিমের নেতৃত্ব দেওয়া। এই দলটি চাঁদের প্রতিকূল পরিবেশ টিকতে পারে এমন লুনার রোভার তৈরি করেছিল। আমাদের করা ডিজাইন দেখতে দলটিকে নাসায় ডেকে নেওয়া হয়েছিল। হিউস্টনের জনসন স্পেস সেন্টারে নাসার প্রকৌশলী এবং মহাকাশচারীদের সামনে আমরা আমাদের নকশা উপস্থাপন করেছি। মা-বাবা আমাকে শিখিয়েছেন-দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে প্রতিভাবান হওয়া যায় কিন্তু সেই প্রতিভা কাজে লাগাতে হলে দরকার সুযোগ।

দৃঢ় নৈতিকতা এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা

আমার বাবা-মা আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকান শিক্ষা ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন হয়েছিলেন। তাঁরা আমাকে শিখিয়েছেন যে সাফল্যের অর্থ গ্রেডের চেয়েও বেশি কিছু।

তাঁরা আমার মধ্যে ইসলামি বিশ্বাসের মূলে নিহিত মূল্যবোধ তৈরিতে সহায়তা করেছেন। বিশ্ব, সততা, কৃতজ্ঞতা এবং অধ্যবসায় সম্পর্কে কৌতূহলী করেছেন আমাকে। বিশ্বের নানা সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ এবং উপলব্ধি করতে উৎসাহিত করেছেন, যা প্রাথমিকভাবে আমাকে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিল।

এই মূল্যবোধগুলো আমি কীভাবে সবকিছুর সাথে যোগাযোগ করি, সে পথ বাতলে দিয়েছিল, শিক্ষা থেকে শুরু করে শিক্ষক এবং সহপাঠীদের সঙ্গে সম্পর্ক পর্যন্ত। যখন কোনো রেফারেন্স লেটারের ব্যাপার আসে, তখন আমার শিক্ষকেরা কেবল আমার গ্রেড সম্পর্কে লেখেননি। তারা একজন মানুষ হিসেবে আমি কে, তা–ও তুলে ধরেছিলেন এবং এটি বাবা-মা আমাকে কীভাবে বড় করেছেন, তা থেকে উঠে এসেছে।

আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এর প্রতিদান দেওয়া- বাবা-মা, আমার সম্প্রদায় এবং যাঁরা আমাকে পথ চলতে সহায়তা করেছেন, তাঁদের সবাইকে প্রতিদান দেওয়া। আমি বিশ্বাস করি যে এভাবেই আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সর্বাধিক সুবিধা অর্জন করব।

অনেক অফারের মধ্যে সালমান পেয়েছেন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি ইন সেন্ট লুইস থেকে ফুলফান্ডেড বৃত্তি। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিও তাঁকে ‘Likely Scholar’ উপাধিতে ভূষিত করেছে। তবে আসছে সেমিস্টারে তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকস পড়তে যাচ্ছেন- একটি আত্মবিশ্বাস নিয়ে, যে সাফল্য শুধু অর্জনের নয়, বরং তুমি মানুষ হিসেবে কে- তাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা- আমার মা-বাবা, আমার কমিউনিটি ও যাঁরা আমাকে এই পথে সাহায্য করেছেন, তাঁদের প্রতি। সালমান চৌধুরীর এই যাত্রা প্রমাণ করে  বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে প্রতিযোগিতামূলক দুনিয়ায়ও আত্মিক সততা, ধারাবাহিকতা এবং পারিবারিক মূল্যবোধ এখনো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তিনি হাজারো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর কাছে এখন নতুন আশার আলো।