‘লোকটা নিজেই আস্ত একটা গান’

‘লোকটা নিজেই আস্ত একটা গান’। এক দিন এক মঞ্চানুষ্ঠানে গাইতে উঠলেন এক কাঁচাপাকা চুলের প্রৌঢ়। নিভু নিভু আলো জোরালো হয়ে উঠতেই দেখা গেল অতি সাদামাটা পোশাকে একটি মানুষ যেন অফিস থেকে ফিরেই মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন। কোনো যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই গেয়ে উঠলেন— ‘দারুণ গভীর থেকে ডাক দাও’। সেই অনুষ্ঠানের প্রসঙ্গ টেনেই পরবর্তীতে কবীর সুমন এমন মন্তব্য করেছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে।

খ্যাতিমান এই কণ্ঠশিল্পী আজ বিদায় নিয়েছেন। অতল সাগরে হারিয়ে গেছেন তিনি। শনিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভারতের কলকাতার একটি হাসপাতালে ৮৩ বছর বয়সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন এই শিল্পী।

মানুষটির জন্ম অবিভক্ত বাংলার বরিশালে। ১৯৪২ সালে। বাবা প্রভাতচন্দ্র ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মা বীণাপাণি মুখোপাধ্যায় গৃহবধূ। দেশভাগের পর পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ায়। স্কুলে পড়াকালীনই তাঁর এক আশ্চর্য ক্ষমতার পরিচয় পান নিকটজনেরা।

মাত্র ১২ বছর বয়সে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘আমি ধান কাটার গান গাই’ কবিতাটিতে সুরারোপ করে বন্ধুদের চমকে দিয়েছিলেন প্রতুল। পাশাপাশি নিজেও লিখতে থাকেন ছড়া, গানের লিরিক। চাকরি করেছেন আর পাঁচজন মধ্যবিত্ত কৃষকের মতোই। কিন্তু সেই গেরস্থালির মধ্যেই কোথাও যেন আগুন ছিল। ধিকিধিকি গানের আগুন। বিপ্লব, স্বপ্নভঙ্গ আবার বিপ্লব আর আবার স্বপ্নভঙ্গের বঙ্গীয় রাজনীতির অনেক উতালপাতালের সাক্ষী প্রতুল রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন সমাজতন্ত্রের শরিক। কিন্তু তা সত্ত্বেও বোধ হয় মানুষ আর মানবতাকে তাঁর গানে সবার আগে রাখতেন।

তার জীবনের প্রথম অ্যালবাম 'পাথরে পাথরে নাচে আগুন' ১৯৮৮ সালে বের হয়, যদিও এটা তাঁর একক অ্যালবাম নয়। তখন অন্য শিল্পীদের সঙ্গে মিলে কাজ করেছিলেন তিনি। তার প্রথম একক অ্যালবাম 'যেতে হবে' ১৯৯৪ সালে বের হয়। তার শেষ অ্যালবাম 'ভোর' (২০২২)।

এছাড়াও তার অন্যান্য অ্যালবামগুলো হলো: 'চক্র চাঁদ জোওয়ান চাঁদ বর্ণনা সহ',  'লাল কমলা হলদে সবুজ', 'দারুন গভীর থেকে', 'বর্ণনার সাথে গিয়েছিলাম লোহার ঘৃণা', 'কি আমদের জাত', 'ভালোবাসার মানুষ', 'কাঁচের বাসনের ঘ্যান ঘ্যান শব্দে', 'মা সেলাই করে', 'সেয়ে ছোটো দুতি পা', 'আমার ধান কাটার গান গাই', 'নাকোসি স্কেলে আফ্রিকা', 'তুমি ছেঁড়া মাটির বুকে আছিস', 'কুট্টুস কোট্টাস', 'স্বপ্নের ফেরিওয়ালা', 'তোমাকে দেখছিলাম', 'স্বপনপুরে'।

'গোসাইবাগানের ভূত' ছবিতে প্লেব্যাকও করেছিলেন প্রতুল মুখোপাধ্যায়।

তার বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে: 'আমি বাংলায় গান গাই', 'লড়াই কর লড়াই, যতদিন না বিজয়ী হও', 'বন্ধু তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন বেচো না', ইত্যাদি।