‘ইয়ালদা নাইট’কী ? যেভাবে বদলে দেয় শীতের আমেজ 

প্রাচীন প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস শরতের শেষ সূর্যাস্ত থেকে শীতের প্রথম সূর্যোদয়—বছরের এই দীর্ঘতম রাতটিকে ইরান ও বিশ্বজুড়ে ইরানিরা পালন করে থাকেন ‘ইয়ালদা নাইট’ বা ‘শব-এ চেলেহ’ হিসেবে। প্রাচীন পারস্যের ক্যালেন্ডারে এই উৎসবের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। 

ঐতিহাসিক তথ্য মতে, খ্রিষ্টপূর্ব ৫০২ অব্দে সম্রাট দানিয়াস দ্য গ্রেটের শাসনামলে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়। ইসলাম ধর্ম আগমনের আগের ও পরের সময়কালেও এই উৎসব ইরানি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে টিকে আছে।

আলো-আঁধারির প্রতীকী লড়াই ইয়ালদা উৎসবের মূল দর্শন হলো আলো ও অন্ধকারের লড়াই। প্রাচীন ইরানিরা বিশ্বাস করতেন, অন্ধকার হলো অশুভ শক্তির প্রতীক। তাই বছরের দীর্ঘতম রাতে অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতে তারা রাতভর জেগে থাকতেন এবং আগুন জ্বালাতেন। শীতকালীন এই অয়নকালকে তারা সূর্যের ‘পুনর্জন্ম’ হিসেবে দেখেন। 

কারণ, এই রাতের পর থেকে ধীরে ধীরে দিন বড় হতে থাকে এবং সূর্যের প্রখরতা বাড়তে শুরু করে, যা মূলত অন্ধকারের ওপর আলোর বিজয়ের প্রতীক।

পারিবারিক বন্ধন ও ঐতিহ্যবাহী ‘করসি’ ইয়ালদা নাইট মূলত পরিবারের মিলনমেলা। এই রাতে পরিবারের সদস্যরা বয়োজ্যেষ্ঠদের বাড়িতে জড়ো হন। উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘করসি’। এটি একটি নিচু টেবিল, যার নিচে হিটার বা আগুন থাকে এবং ওপরটা মোটা কম্বল দিয়ে ঢাকা থাকে। পরিবারের সবাই এই করসির চারপাশে বসে গল্পগুজব ও আড্ডায় মেতে ওঠেন, যা আধুনিক যুগেও ইরানি পরিবারগুলোর মধ্যে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় রাখে।

সাহিত্য ও হাফিজের কবিতা পাঠ ইয়ালদা নাইট কেবল খাওয়া-দাওয়ার উৎসব নয়, এটি সাহিত্যেরও এক অনন্য মিলনস্থল। এই রাতে ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’ এবং মহাকবি হাফিজের ‘দিওয়ান-এ হাফিজ’ থেকে কবিতা পাঠ করা একটি অপরিহার্য রীতি। 

একটি জনপ্রিয় প্রথা হলো—মনে মনে কোনো ইচ্ছা পোষণ করে দিওয়ান-এ হাফিজের পাতা খোলা। সেখান থেকে যে কবিতাটি সামনে আসে, সেটিকে নিজের ইচ্ছার উত্তর বা ভবিষ্যৎ নির্দেশনা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

তরমুজ ও ডালিমের বিশেষত্ব এই রাতের খাবারে ফলমূল ও বাদামের বিশেষ প্রাধান্য থাকে। বিশেষ করে তরমুজ ও ডালিম ইয়ালদা নাইটের প্রধান প্রতীক। এই ফল দুটির লাল রঙ উদীয়মান সূর্যের তেজ ও জীবনশক্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। 
ডালিমকে মনে করা হয় সুখ ও উর্বরতার প্রতীক। অন্যদিকে, গ্রীষ্মের ফল হওয়া সত্ত্বেও বিশ্বাস করা হয় যে, ইয়ালদা নাইটে তরমুজ খেলে শীতকালে রোগব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা যায়। এছাড়া নানা পদের বাদাম (পেস্তা, আখরোট, হ্যাজেলনাট) এবং মিষ্টির আয়োজন উৎসবের জৌলুস বাড়িয়ে দেয়।

আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ইরানের বিশাল ভৌগোলিক পরিসরে এই উৎসবের ঢংও ভিন্ন ভিন্ন হয়:

 * খোরাসান: এখানে ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ‘কাফ’ তৈরি করা হয় এবং বড় পরিসরে শাহনামা পাঠের আসর বসে।

 * তাবরিজ: এই শহরে ‘আশিক’ নামক লোকসংগীতশিল্পীরা রাস্তায় গান গেয়ে উৎসবের আবহ তৈরি করেন।

 * লোরেস্তান: তরুণরা প্রতিবেশীদের ছাদে উঠে স্কার্ফ নামিয়ে খাবার সংগ্রহের ঐতিহ্যবাহী খেলা ‘শোভ-ই আভাল-ই কারেহ’ পালন করে।

 * কোর্দেস্তান ও জানজান: এই অঞ্চলগুলোতে স্থানীয় মিষ্টি, বাকলাভা এবং দোলমা দিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করা হয়।
জাতীয় স্বীকৃতি সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে ২০০৮ সালে ‘ইয়ালদা নাইট’কে ইরানের জাতীয় সম্পদের তালিকায় আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত করা হয়। 

আজও এই উৎসব ইরানিদের হৃদয়ে নতুনের আগমনী বার্তা এবং অন্ধকারের পর আলোর প্রত্যাশাকে জাগিয়ে রাখে।

তথ্যসূত্র: মেহের নিউজ এজেন্সি