গল্প! আমার তো মনে হয়, আমি জন্ম নিয়েই গল্প লিখতে শুরু করেছি। আমি বলতে চাইছি, মানুষের জন্মটাই গল্পের ভেতর দিয়ে। নারী-পুরুষের ভালোবাসা বা প্রেম বা শরীরের সংগ্রাম সবই তো গল্পের বাসভূমি থেকে উৎসারিত। ওই সব ঘটনা অনানুষ্ঠানিক। যদি অনানুষ্ঠানিকভাবে বলি, আমি গল্প লিখতে শুরু করি প্রায় শৈশব থেকে। যতদূর মনে পড়ে এইটে বা নাইনে পড়ার সময় প্রথমে গল্প লিখি। অবশ্যই ছোটদের গল্প। কীভাবে গল্পের জগতে প্রবেশ করেছিলাম; তাও গল্পের আখ্যান। আমাদের বাড়িতে, সেই অজপাড়াগাঁয়ে, বলছি আমি আজ থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ঘটনা। আমার বাবা তবিবুর রহমান, মা ফজিলাতুন নেসা পুষ্প বই পড়তেন। শরৎচন্দ্রের অনেক বই আমাদের বাড়িতে ছিল। ‘পণ্ডিতমশাই’ উপন্যাসটি আমি সেই সময়েই পড়েছিলাম। আমার বড় ভাই রুহুল আমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তারও পড়ার অভ্যাস ছিল। গানও লিখতেন। তো তিনি বাড়িতে এক ট্রাঙ্ক বই এনেছিলেন; গল্প, উপন্যাস। আমি দোতলার খাটের নিচে সেই বই আবিষ্কার করে পড়তে থাকি। সেই সময়েই আমি বড়দের অনেক বই পাঠ করেছি। সেই সব বই পাঠ করতে করতে আমার ভেতরে জেগে ওঠলো এক সৃজন সত্তা, সেই সত্তা আমাকে বললো, তুমিই লিখতে পারো। আমি একদিন রুল টানা লম্বা খাতা নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। যতদূর মনে পড়ে; একটা প্রলেতারিয়েত মার্কা গল্প লিখেছিলাম। তো সেই শুরু; বরিশালের পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার পশ্চিমপ্রান্তে কচানদীর পাড়ে বোথলা গ্রামের এক নির্জন বাড়িতে আমার লেখার অঙ্কুর উদগম হয়েছিল… হয়তো সকালে, নয়তো বিকেলে, অথবা রোদজ্বলা দুপুরের কোনো এক সময়ে।
গল্প না লিখে উপায় নেই আমার, তাই গল্প লিখি। একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে চারদিকে বিরামহীন গল্পের আসা-যাওয়া দেখি। গল্পেরা আমার সঙ্গে দিনরাত গল্প করে। চারপাশে এত এত গল্প দেখি, গল্পের জলে বাস করি, গল্পের নাচ দেখি, মগ্ন ঝগড়া দেখি, গল্পের মান অভিমান দেখি, ফলে আমার ভেতরে এক ধরনের সৃজন গীত তৈরি হয়। একটা নাড়া খাওয়া এক ধরনের যন্ত্রণার মধ্যে নিপতিত হই, সেইসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া জন্য গল্প আমাকে বাধ্য হয়ে লিখতে হয়। গল্প না লিখলে আমি ঘুমুতে পারি না। গল্প না লিখলে গল্পেরা অভিমান করে আদুরে প্রেমিকার মতো। অনেক সময়ে আমাকে গলা টিপে হত্যা করতে আসে। এতকিছুর পরও যদি গল্প না লিখি গল্পেরা সাপের ফণা তুলে আমার দিকে ধেয়ে আসে, আমি বাধ্য হই লিখতে। গল্প লেখার পরই পাই মুক্তি। আহ কী আরাম, কী আনন্দ! কী সুখ। এইসব সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোর সঙ্গে বাস করার জন্য আমি গল্প লিখি। গল্পের সঙ্গে আমার ঘর গৃহস্থালি।
গল্পের সঙ্গে থাকতে থাকতে আমার মনে হয়, মানুষের জীবন, গল্পেরই জীবন। গল্প ছাড়া মানুষের জীবন ভাবাই যায় না। প্রতিটি মানুষের জীবনে শত শত নয়, হাজার হাজার গল্প আছে। একজন মানুষ এক জীবনে তার গল্প লিখে শেষ করতে পারবে না। আমি, আমার এই সামান্য জীবনে যত গল্পের মালিক, সব গল্প তো পাঠকদের জন্য লিখে যেতে পারবো না। সময় ও সুযোগ আমাকে আটকে রেখেছে। আমার মতো অন্য গল্পকারদেরও আটকে রাখছে। বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য গল্প লেখা জরুরি, খুব জরুরি।
গল্প লেখার বিষয়ের কি অভাব আছে অন্তত দারিদ্র্যপীড়িত, ক্ষমতালিপ্সায় তাড়িত একদল পঙ্গপাল মানুষের লম্ফঝম্ফ দেখে, স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে যখন দেখি রক্ত, কাটা মুণ্ডু, হাসে বীভৎস, দেশের হাজার হাজার তরুণ বৃদ্ধ নর-নারী শিশু যখন ভিন দেশের সাগরের বুকে তড়পায়, আমার বোন ফেলানী যখন সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায় ঝোলে রক্তাক্ত; তখন কি একজন প্রকৃত গল্পকারের গল্পের বিষয়ের অভাব হয়? ব্যক্তিগতভাবে আমি মানুষের মনের আয়নাটা ধরতে চাই। একজন মানুষ সুটেট বুটেট, যাচ্ছে হেঁটে চমৎকার। যে কেউ দেখলে ভাববে, মানুষটি দারুণ সুখী। আসলে কি সুখী? কিংবা বয়ে বেড়ায় টন-টন সুখ? আমি একজন লেখক বা গল্পকার হিসেবে ওই মানুষটিকে আমার গল্পের কলকব্জায় নিয়ে আসি, তাকে ব্যবচ্ছেদ করি, দেখতে ও দেখাতে চাই; আমরা সোজা চোখে যা দেখি, সেই দেখা ঠিক না। দেখার মধ্যেও প্রচুর অদেখা থেকে যায়। দেখা ও অদেখা, জানা ও অজানা, মন ও জানালা, পাথর ও ফুল, কাঁটা ও রক্ত আমার গল্পের বিষয়।
পাঠকরা পড়ে, দেখা হলে জানান দেয়, কিংবা ফোনে বলেন গল্প পাঠ শেষে তাদের প্রতিক্রিয়া। সব সময়ে পজিটিভ হয়, তাও না। তবে যখন কোনো কোনো পাঠক প্রশ্ন করেন, ওই গল্পটা ওভাবেও শেষ না করলে পারতেন। আরে বাবা, গল্প লিখি আমি, গল্পের আখ্যান ভাবি আমি, আমিই আমার গল্পকে কোথায় নিয়ে যাবো নাকি রসগোল্লা খাইয়ে বাসে তুলে দেবো সেটা আমার ব্যাপার। তুমি, দেখো গল্পটা শিল্পসম্মত হয়েছে কিনা? দেখো, এই তোমার জীবনের বারান্দায় দোল খায় কিনা!
তো এই সব ঘটনার মাঝে পাঠকদের ওপর একটা প্রভাব তো পড়েই। নইলে লেখার জন্য প্রেরণা আসবে কোত্থেকে? সব কিছুর ওপরে পাঠক সত্য তাহার ওপরে নাই।
গল্প লেখার সার্থকতা বলতে কী বোঝায়, আমাকে পরিষ্কার করে বলবেন? আপনি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় যাবেন, যাওয়ার জন্য আপনাকে তো যাত্রা করতে হবে। যাত্রা না করেই যদি বলেন, আমি পৌঁছাতেই পারলাম না। নিট ফলাফল কী দাঁড়ায়? আপনি কখনই যেতে পারবেন না। একজন গল্পকার বা কথাসাহিত্যিকের কাছে লেখার সার্থকতা বহুমাত্রিক চৈতন্যের বসতবাড়ি।
গল্পকার যদি গল্প লেখার সার্থকতা নিজের মধ্যে না পান বা আবিষ্কার করতে না পারেন, তিনি লিখবেন কী করে? আর কেনইবা লিখবেন? মূলত একজন গল্পকারের গল্প লেখার ভেতরই সার্থকতা বহুলাংশে নির্ভর করে।
প্রথম থেকে আমার বারোটা গল্পের বইয়ের নাম বলি। বইগুলো হচ্ছে; এক ঝাঁক মানুষের মুখ, প্রকৃত নায়ক, ন্যাড়া একটি বৃক্ষ, একজন নারী তিনজন পুরুষ ও একটি চুলের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, থৈ থৈ নোনাজল, আঠারো বছর পর একদিন, একটি খুনের প্রস্তুতি বৈঠকের পর, ইতিহাসের বেলিফুল, ঘাসকন্যা, ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ ও অন্যান্য গল্প। এরপরও আরও কয়েকটি গল্পবই প্রকাশিত হয়েছে। কথাপ্রকাশ বের করেছে আমার ‘পঞ্চাশ গল্প।’
প্রতিটি গল্পের বই আমার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং অনিবার্যভাবে প্রিয়। আবার প্রিয়’র মধ্যেও আরও প্রিয় কোনটি, এই প্রশ্নে আমি বলতে চাই, কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘ঘাসকন্যা’ ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত ‘থৈ থৈ নোনাজল’, নওরোজ কিতাবিস্তান থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ ‘১০ জানুয়ারী ও ১৯৭২ ও অন্য গল্প’ আমার প্রিয় থেকে প্রিয়তর গল্পগ্রন্থ। এ বইগুলোর অধিকাংশ গল্প, গল্পের আখ্যান খুব সংহত। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে পারি, আমি এ বইয়ের গল্পগুলো খুব চিন্তা ও পরিকল্পনা করে লিখেছি। ফলে যে কোনো পাঠক গল্পগুলো থেকে আমাকে খুব নিবিড়ভাবে আবিষ্কার করতে পারবে।
কজন গল্পকারের সব গল্প প্রিয় হয় না, নানা কারণেই হয় না। এক সময়ে যে গল্পটি গল্পকারের খুব প্রিয় হয়, সময় বা রুচির কারণে সেই গল্পটি পছন্দের তালিকায় নাও থাকতে পারে। মানুষের মন যেমন বিচিত্র পছন্দ, অপছন্দের তালিকা আরও বিচিত্র। আর লেখককের মন তো আরও অস্থির, স্থির থাকে না কোথাও ক্ষণকাল; সময়ের সঙ্গে, স্রোতের সঙ্গে বা বিপরীতে কেবল বহিয়া যায় অবিরাম।
এইসব দ্বৈত অদ্বৈত চেতনার কারণে; না, আমার লেখা সব গল্প আমার কাছে প্রিয় নয়। আবার আমার কাছে যেসব গল্প প্রিয়, দেখেছি অনেক পাঠকের কাছে সেটা প্রিয় নয়, আমার কাছে দুর্বল গল্পটাই তার কাছে অধিকতর প্রিয়। পাঠকদের নিজস্ব মতামত, রুচি, সৌন্দর্যবোধ, গল্প মন্থন করার আবেগ, ইন্দ্রিয় ঘ্রাণ, লেখাপড়ার দৌড়, জানার ইচ্ছের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। আমার কাছে আমার লেখা বেশ কয়েকটা গল্প প্রিয়। যেমন: ঘাসকন্যা, রক্ত মাংসের মানুষ, মন সংক্রান্তি, রক্ত ও রূপান্তরের গল্প, তিমিরেরও তিমির, স্পর্শ, পাখি, টস, কুলসুম ও একজন পাহারাদার, খেলা শেষে আইনুদ্দিন, এই তো নদীর খেলা, ইঁদুর মডেল, অপরাধবোধ, ভেতরের মানুষ, বারান্দায় দেখা আলো ও অন্ধকার, একজন নারী তিনজন পুরুষ ও একটি চুলের গল্প, ধিকিধিকি, পাশবিক পাশা খেলায়, আত্মঅবলোকন, পারুল বোনটি আমার, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, খেলা, খোয়াজ খিজির, একটি ভোরের গল্পসহ আরও কিছু গল্প, আমার কাছে প্রিয়। আবার দশ বছর পর এই তালিকা পরিবর্তনও হতে পারে। এই গল্পগুলোর বাইরে আরও গল্প আছে, যে গল্পগুলোয় আমি বাংলার জল, জমিন, মানুষ; বিচিত্র মানুষের কাম ক্রোধ লোভ লালসা প্রেম-অপ্রেম উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।
আজ যে আপনি আমার সঙ্গে আমার গল্প, গল্পের কলকব্জা নিয়ে কথা বলছেন; যদি দেশটা স্বাধীন না হতো, আমি কি গল্প-উপন্যাস লিখতাম? আপনি কোথায় থাকতেন; আপনিও জানেন না। আমি বাংলা অ্যাকাডেমিতে চাকরি করি, বাঙালিরা এই প্রতিষ্ঠানের ডিজি, পাকিস্তান থাকলে এই প্রতিষ্ঠানের ডিজি হতো একজন পাকিস্তানি। আামদের শিখতে হতো উর্দু ভাষা। আর সব সময়ে পা চাটতে হতো ওই প্রভুদের ভয়ার্ত কুকুরের মতো। এইভাবে আপনি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন, পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হতো। দেখুন না চব্বিশ বছরে, পাকিস্তানিরা আমাদের দেশের একজন ক্রিকেটারকে ক্রিকেট খেলতে দেয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র তিনজন বাঙালি সচিব ছিলেন। আর্মির অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়। মেজরের ওপরে কোনো বাঙালির পদ ছিল না। কারণ, ওরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতো, বাঙালিরা ভীতু। আরও ভয় পেত; বাঙালিদের বড় জায়গা পেলে দক্ষতা প্রকাশ করলে একদিন অধিকার চেয়ে বসবে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। আমার দেশে আমি আপনি স্বাধীন সত্তায় বুক ফুলিয়ে হাঁটি। কথা বলি। গল্প লিখি। নিজেকে শিল্পের আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছি; এই যে অর্জন এর সবটুকু একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতার অর্জন। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তো লিখতেই হবে, মাটির কাছে, নদীর কাছে, পাখির কাছে, ফসলের কাছে, আমার কাছে আমার এ অঙ্গীকার। ফলে, যখনই অনুরুদ্ধ হয়েছি কিংবা মনের কোণে কোনো আখ্যান এসেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছি; গল্প। সেইসব গল্প নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প নামে একটি গ্রন্থ, শোভা প্রকাশ থেকে।
গল্প লেখা অবিরাম চলতে থাকবে। যতদিন মানুষ থাকবে, মানুষের গল্পও থাকবে। এবং গল্প লেখাও চলবে। গল্প ছাড়া কি মানবসভ্যতা চলে? সভ্যতার প্রথম চরিত্র; গল্প। গল্পের ভেতরে মানবযাত্রার ইতিহাস যেভাবে এসেছে, পৃথিবীর অন্য কোনো সাহিত্যে তেমনভাবে আসেনি। আমি বাংলা ভাষার গুটিকয়েক গল্প ও গল্পকারের নাম বলছি; রবীন্দ্রনাথের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ ও ‘মহানগর’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অতসী মামী’, জগদীশ গুপ্তের ‘শঙ্কিত অভয়া’, সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’ ‘অযান্ত্রিক’; এসব গল্পের আখ্যানে যেমন মানুষের সর্বনাশ এসেছে, তেমন এসেছে লড়াইয়েরও ইতিহাস। সুতরাং সভ্যতা পাঠ মানে গল্প পাঠ। গল্পের বিকাশ মানে; গল্পের বিকাশ। গল্প ছাড়া অচল পৃথিবী।
মৃত্যুর মতো। যেহেতু পৃথিবীতে প্রাণী হয়ে জন্মেছি, মৃত্য অনিবার্য। আমি মৃতুকে প্রিয়তমা প্রেমিকার মতো আলিঙ্গন করতে চাই চুম্বনের মতো। মৃত্যুর কাছে একটাই প্রার্থনা, মৃত্যু আপনি আসুন আমার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষের কাছে যা পেয়েছি, তার তুলনা নেই। হয়তো আরও পাওয়ার ছিল, পাইনি, দুঃখবিলাস নেই। সুস্থ সবল দেহে যেন মৃত্যুবরণ করি। কারও করুণা, কারও কাঁধে হাত রেখে ধুঁকে ধুঁকে মরতে চাই না… আমার মনে হয় না মহামান্য মৃত্যুর কাছে আমি বেশি কিছু চেয়েছি।