অগ্নিকা আঁধার: উপন্যাসে পর্যুদস্ত সমাজের পুনর্নির্মাণ

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে মৌলিক গুণগত পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে; এরই সমান্তরালে উচ্চশিক্ষা কেবল মানুষের জীবনযাপনের ধরনকে পরিবর্তিত করে না, সঙ্গে জাতীয় উন্নয়নের গতিপথকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে। উচ্চশিক্ষার স্রোতধারা ও রূপ নির্ধারণ করে দেয় জাতীয় জীবনের গতিপথ। সমাজকে সভ্যতার উৎকৃষ্টতায় সওয়ার করতে সমৃদ্ধ উচ্চশিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। উচ্চশিক্ষার গতিপথকে নানান সময়ে নানারূপে নির্মাণ করবার চেষ্টা ও অপচেষ্টা ঐতিহাসিকভাবে পরিলক্ষিত। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার এক অনিবার্য সংস্করণ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়; যা একদিকে অধিক সংখ্যক জনগোষ্ঠীর সামনে উচ্চশিক্ষার অবারিত সুযোগকে উন্মুক্ত করেছে, ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষাঙ্গনের ‘প্রাইভেটাইজেশনে’র ফলে নানামাত্রিক জটিল-আবর্তকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলের বার্তা আমাদের সামনে নানানভাবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে আসে, কিন্তু ভেতর থেকে পর্যবেক্ষণ করা ও শৈল্পিক উপায়ে প্রকাশ করাবার মতো জহুরি দৃষ্টি অনেক গণমাধ্যমেরই নেই; অবশ্য গণমাধ্যমের কাজও তা নয়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভেতর-বাহির’ আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন সমকালীন বাংলা সাহিত্যের এক সমৃদ্ধ জহুরি দৃষ্টিধারী সাহিত্যনির্মাতা রকিবুল হাসান; এ সম্পর্কিত আখ্যান তার অগ্নিকা আঁধার উপন্যাস।

উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ জাতির উন্নয়নের বাতিঘর হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার কথা। এরূপ প্রত্যাশা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক শিক্ষার বহুল বিস্তারে কাজ অব্যাহত। দেশ ও জাতিকে নতুনরূপে আলোর সন্ধান দেওয়ার প্রত্যাশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে অনাকাক্সিক্ষত অনেক বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছে দেশের উচ্চশিক্ষা। অগ্নিকা আঁধার উপন্যাসে এরূপ অনভিপ্রেত বাস্তবতার আখ্যান পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন ঔপন্যাসিক। আখ্যানের বয়ানে তিনি শিরোনাম হিসেবে চিত্তাকর্ষক শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন। বয়ানের শিরোনাম হিসেবে তুলে ধরেছেন ‘চেয়ার ও মধুমক্ষিকা’, ‘সাধকের সাজা’, ‘নষ্টরাজের ফাঁদ’, ‘বিধায়কের বিধান’ ও ‘তবুও আলো।’ এসব শিরোনামের তাৎপর্যবহুলতা বিদ্যমান এবং শাব্দিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূলসুর ধরে ফেলা সম্ভব। প্রচলিত ঘরানার উপন্যাসে যে বয়ানরীতি লক্ষিত, এ উপন্যাসে ঔপন্যাসিক নির্মাণ ও পরিবেশনে তা পূর্নরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলকে জানান দিতে ঔপন্যাসিক প্রসঙ্গক্রমে পাঠককে বাংলার জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিয়েছেন। জাতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির রথী-মহারথীদের উপস্থিতিতে এ উপন্যাসের প্রাসঙ্গিকতা কালোত্তীর্ণতার দাবি রাখে। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উপস্থিতি জানান দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, মীর মশাররফ হোসেন, লালন শাহ, হাছন রাজাসহ বাঙালিত্ব ধারণ করা মনীষীজন। বাংলা জনপ্রিয় ধারার ঔপন্যাসিক আকবর হোসেন ও মোহাম্মদ নজিবর রহমান; এসব চরিত্রের উজ্জ্বল উপস্থিতি উপন্যাসের ব্যাপ্তিগত সম্পূর্ণতাকে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করেছে। 
উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ড. অনিন্দ্য অর্ঘ। এর পাশাপাশি ড. ফারজানা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারিহা, পিওন আরিফুল, এম. জামাল খান উপন্যাসের আখ্যানকে এমনভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, তার মাধ্যমে ঔপন্যাসিকের সৃষ্টিশীলতার বার্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। আলোচ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের নানামাত্রিক ঘটনাপ্রবাহ, কর্মরত শিক্ষকদের আবশ্যক যোগ্যতার বৃত্তান্ত বিশেষভাবে আখ্যানভাগে স্থান পেয়েছে।

কাহিনি পর্যালোচনায় ডক্টর সাদিক আহসানের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব শুরু করে ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ। বিভাগের পূর্ববর্তী প্রধান ফারজানার স্থলাভিষিক্ত হন তিনি; এক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে ক্রিয়াশীল ছিল ডক্টর অনিন্দ্য মহোদয়ের মেধা ও সততা। নানামাত্রিক জটিলতায় দেশের প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষককে কর্মজীবন অতিবাহিত করতে হয়। প্রত্যাশিত কল্যাণ নিশ্চিত করা অনেকসময় দায়িত্বপ্রাপ্তদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বিভাগের প্রধান হিসেবে ডক্টর অনিন্দ্যর কর্মসমূহ কল্যাণকে লক্ষ্য করে গৃহীত হলেও বিভাগসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমাত্রিক জটিল ব্যবস্থাপনায় নানাবিধ জটিলতার সম্মুখীন করে। তার শুভবোধ ও আদর্শলোক কলঙ্কিত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টা এম. জামাল খান। জামাল খানের চক্রান্তে বাধাগ্রস্ততাসহ অবমাননার শিকার হতে বাধ্য হয় আলোকবর্তিকাসহ ডক্টর অনিন্দ্যর কার্যসমূহ। বিরুদ্ধ প্রতিবেশে ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ ও ডক্টর সাদিক আহসান অস্তিত্বের সংকটে অবতীর্ণ হন, নেতিবাচকতার উত্থানকে স্বীকার করে নেন; কিন্তু বিসর্জন দেননি সত্যের সঙ্গে বসবাসের সহজাত জীবনবোধ। বিপ্লবী বাঘা যতীনের সংগ্রামমুখরতায় মুগ্ধ প্রধান চরিত্র নিজেকে সমর্পণ করেছেন আদর্শের নিত্যসঙ্গ স্বীকার করে। আদর্শের আলো বুকে করে পথ চলতে নতুন করে নতুন পথের সন্ধানে ধাবিত হয়েছেন ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ নামক বাতিঘর; যাকে অনায়াসে এই মহামারীর যুগে আলোকশিখা হিসেবে অভিহিত করা যেতে পারে।

কেবল আখ্যানভাগের সম্পূর্ণতাই নয়; এখানে বাংলার সংস্কৃতির অতীত স্বমহিমায় উপস্থাপিত হয়েছে। বাংলার ইতিহাস, সাহিত্য, রাজনীতি সংশ্লেষণের মাধ্যমে অগ্নিকা আঁধার বিশেষ সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন, ভাষা-আন্দোলন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশেষভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এই উপন্যাসে। এই প্রসঙ্গে শিল্পসফলতার নিরিখে এই রচনাটিকে শিল্পসফল কালের দলিল হিসেবে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ত্রয়ী রচনা পূর্ব-পশ্চিম, প্রথম আলো ও সেই সময় এর পাশাপাশি বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ রচিত দেয়াল, বাদশাহ নমদার ও জোছনা ও জননীর গল্প যেমন বিশেষ দালিলিক সাহিত্যকর্ম হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে; তেমনি অগ্নিকা আঁধারের মাঝেও পূর্বোক্ত উপন্যাসসমূহের মতো কালকে প্রতিবিম্বিত করবার গুণাবলি বিদ্যমান। 

এই উপন্যাসে রচয়িতা বাংলার রাজনৈতিক ঘটনাবলির উল্লেখ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণে বিপ্লবী বাঘা যতীনের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। অবিভক্ত বাংলার কুষ্টিয়ায় জন্মগ্রহণ করা বাঘা যতীন ইংরেজ সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে ইতিহাসের এক মহান বীর হিসেবে স্বীকৃত। ১৯১৫ সালে তিনি বালেশ্বরের বুড়িবালামে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এক অসম সামরিক মোকাবিলা করেন পরম সাহসিকতায়।

বাংলা সাহিত্যে নানামাত্রিক বিষয় আত্মীকৃত হয়েছে। বাউলতত্ত্ব তেমনই এক অনুষঙ্গ; যা সাহিত্যিকগণ বিশেষভাবে সাহিত্যে প্রতিফলনের প্রয়াস পেয়েছেন। আলোচ্য উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগণ গরকরা ও লালন শহের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন ঔপন্যাসিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউলতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে গগণ হরকরার গানের সুরের অনুকরণে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’গানের সুরারোপের বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালন সাঁইজির বিভিন্ন গানের দর্শন দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন ঔপন্যাসিক। রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন দেবতা’ দর্শনসহ অন্যান্য অনেকক্ষেত্রে লালন সাঁইজির প্রভাব বিশেষভাবে প্রত্যক্ষমান।

গঠনকাঠামো বিবেচনায় রকিবুল হাসানের এই উপন্যাস স্বতন্ত্রতার দাবি রাখে। বক্তব্য প্রকাশে ঔপন্যাসিক ব্যবহার করেছেন শিল্পের নানা অনুষঙ্গ। অত্যন্ত সাবলীলভাবে ঔপন্যাসিক এখানে প্রয়োগ করেছেন উপমা, উৎপেক্ষা আর চিত্রকল্প। এর পাশাপাশি এখানে লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মশাররফ হোসেন, সৌমিত্র চট্ট্যোপাধ্যায়, আকবর হোসেন প্রমুখের অস্তিত্ব, চিন্তন ও সৃষ্টিকর্ম নিয়ে বিশেষভাবে আলোপাত করা হয়েছে। দুই বাংলার পারস্পারিক সাংস্কৃতিক মিথস্ক্রিয়া, প্রণয়, সাহিত্যের প্রবহমান ধারাও এসেছে এ পর্বে। এরই সমান্তরালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক জটিলতা, শিক্ষকদের অবমাননা, তাদের হয়ে ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদি উপন্যাসের প্লটকে সমৃদ্ধ করেছে।

উপন্যাসে যে আখ্যান তুলে ধরা হয়েছে তা এক পরাভূত সমাজের উৎকৃষ্ট চিত্রায়ণ। চতুর্পাশের খলনায়কদের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকে সমাজস্থ মানুষের কাছে অনুসরণীয় বা নায়ক হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস দুরূহ বটে। এই বহুমাত্রিক জটিলতর পরিস্থিতিতে ডক্টর অনিন্দ্য অর্ঘ চরিত্রকে সবার কাছে আদর্শ চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন একটি সামাজিক বার্তাকে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করে। নেতিবাচক চর্চার বিপরীতে অগ্নিকা আঁধারের আখ্যান আমাদের সমাজকে পুনর্বার নতুনভাবে জীবনবিন্যাসে উজ্জীবিত করে। এতে প্রতিগৃহীত বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি আর সমৃদ্ধ অতীত আমাদের সমাজের পুনর্নির্মাণে বিশেষ সঞ্জীবনী শক্তি হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকবে বলে অনায়াসেই বিশ্বাস স্থাপন করা যায়। সবশেষে, রকিবুল হাসানের অগ্নিকা আঁধার এই সমাজের পুনর্নির্মাণের এক অনন্য প্রয়াসই বলা চলে।