একুশ শতকের বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যে কবিতা, কথাসাহিত্য, নাটক, গানসহ বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশের ধারক-বাহক হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে হয়ে উঠেছে—কবিতা ও কথাসাহিত্যের আবেগপ্রবণ প্রবাহের বিপরীতে সাম্প্রতিক প্রবন্ধসাহিত্য বিশ্লেষণ, যুক্তি ও ভাষিক শৃঙ্খলার মাধ্যম।
এই সময়ের প্রবন্ধসাহিত্য নিছকই কোনো সাহিত্যিক রূপ নয়—এটি জাতির চিন্তার আয়নাও। সমাজের অসঙ্গতি, শিক্ষার দুর্বলতা, রাজনৈতিক সংকট কিংবা সাংস্কৃতিক দীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, কখনো ক্ষোভে, কখনো ব্যঙ্গ-রসে, আবার কখনো হৃদয়বিদারক বর্ণনায়। বিশেষত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে লেখা প্রবন্ধগুলো আমাদের আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদা ও ইতিহাসচেতনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আলোচ্য সময়ের প্রবন্ধসাহিত্যের প্রধান কুশীলবদের কয়েকজন হলেন—তপন বাগচী, রকিবুল হাসান, কাজী মহম্মদ আশরাফ, মোহাম্মদ নূরুল হক, চন্দন চৌধুরী, মামুন রশীদ, কুমার দীপ, জান্নাতুল যূথী, রঞ্জনা বিশ্বাস, মোজাফফর হোসেন, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ও ফজলুল হক তুহিন।
তপন বাগচী কেবল একজন কবি নন, একজন গীতিকার, গবেষকও। তার সাহিত্যকর্মে যেমন আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া রয়েছে, তেমনি রয়েছে দেশপ্রেম, মানবিকতা ও সমকালীন সমাজ-বাস্তবতার গভীর অনুধ্যান। কবিতা-গান ছাড়াও তিনি প্রবন্ধ ও গবেষণায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও সংগীত নিয়ে তার গভীর অনুসন্ধানী-বিশ্লেষণাত্মক প্রবন্ধ পাঠককে সমৃদ্ধ করে। তার লেখায় ঐতিহ্য, লোকসংস্কৃতি ও সমকালীন সমাজ-সংকটের বিশ্লেষণ একসঙ্গে পাওয়া যায়। এই প্রাবন্ধিকের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ—‘নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার’, ‘সাহিত্যে সাম্প্রতিক পাঠ’, ‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : জীবন ও কবিতা’, ‘বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’, ‘চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান’, ‘লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ’, ‘সাহিত্যের সঙ্গ অনুষঙ্গ’, ‘লালন মতুয়া ও লোকসংগীত অন্বেষা’, ‘সংবাদের ভাষা ও সাময়িকপত্র পর্যালোচনা’, ‘রবীন্দ্রসাহিত্যে নতুন প্রেক্ষণ’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধ আখ্যান’, ‘সাহিত্যের কাছে-দূরে’ ও ‘সাহিত্যের এদিক সেদিক’ ইত্যাদি।
সমকালীন বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য যাদের চিন্তা-চেতনা ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম একজন রকিবুল হাসান। তিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েও অ্যাকাডেমিক নন; বরং একজন মননশীল প্রাবন্ধিক, গবেষক ও চিন্তাশীল ভাষ্যকার—যিনি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আলোচনা করে থাকেন। তার প্রবন্ধসমূহ শুধু তথ্যনির্ভর নয় বরং তাত্ত্বিক ও দর্শনচিন্তায় ভরপুর—যেখানে ঐতিহ্য আর আধুনিকতার সংঘাত-সন্ধির স্পষ্টতা পাওয়া যায়। এই লেখকের উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘সাহিত্যের নন্দনচর্যা’, ‘পঞ্চাশের সাহিত্যে জনপ্রিয় যুবরাজ’, ‘ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ও ফোকলোর’, ‘বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা : মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন’, ‘বিপ্লবী বাঘা যতীন’, ‘আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য : রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি’, ‘কয়ায় রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাঘা যতীন ও প্রাজ্ঞজন’। প্রবন্ধ গ্রন্থ: ‘গড়াই নদীর পাড়’, ‘পথে যেতে যেতে’, ‘পথের কথা’, ‘কঠিনেরে ভালোবাসিলাম’, ‘প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির’ ও ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন’।
কাজী মহম্মদ আশরাফ সমকালীন গদ্যকারদের মধ্যে শক্তিমান এক প্রাবন্ধিক। তার গদ্যে ভাষার সৌন্দর্য যেমন পরিলক্ষিত হয়, তেমনি বিশ্লেষণের নিখুঁত দিক পাঠককে ভাবনায় নিমগ্ন করে তোলে। তিনি কোনো বিষয় নিয়ে লেখার সময় কেবল উপস্থাপন করেন না বরং সেই বিষয়টিকে পাঠকের চিন্তার গভীরে প্রবেশ করিয়ে দেন। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হলো, ‘হাসান হাফিজুর রহমান ও অন্যান্য’, ‘আঞ্চলিক উপভাষা : মুন্সীগঞ্জ’, ‘শামসুর রাহমান : প্রকৃত শিল্পীর প্রতিকৃতি’, ‘বাংলাদেশের সাহিত্যে নারী’ ও ‘রবীন্দ্রনাথ : বৃষ্টির কবিতা’।
মোহাম্মদ নূরুল হক বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের একজন বিশিষ্ট কবি, চিন্তাবিদ ও মননশীল লেখক। কবিতার পাশাপাশি তার প্রবন্ধগুলো সাধারণত যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, দার্শনিক মনোভঙ্গি ও মানবতাবাদী চেতনার এক অনন্য সংমিশ্রণ বহন করে। তিনি আধুনিক বাংলা প্রবন্ধের ভাষাশৈলী, বিন্যাস ও বিষয় নির্বাচনে যে প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করেছেন, তা তাকে এই ধারার একজন অন্যতম পথিকৃৎ করে তোলে। তার প্রবন্ধগুলোর মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা পেয়েছে এক পরিশীলিত, প্রাঞ্জল ও যুক্তিনির্ভর প্রকাশভঙ্গি—যা ভবিষ্যৎ প্রবন্ধকারদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবে। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হলো, ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’, ‘সমালোচকের দায়’, ‘অহঙ্কারের সীমানা ও অন্যান্য’, ‘সাহিত্যের রাজনীতি’, ‘সমকালীন সাহিত্যচিন্তা’, ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’, ‘আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন ও অন্যান্য’, ‘বাংলা উপন্যাসে বিধবা : বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ-শরৎ’, ‘আধুনিক বাংলা কবিতা : ছন্দের অনুষঙ্গে’, ‘বাক-স্বাধীনতার সীমারেখা’, ‘কথাসাহিত্যের চিন্তাসূত্র’ ইত্যাদি।
চন্দন চৌধুরী শুধু কবিতা লেখাতেই সীমাবদ্ধ নন, বাংলা ভাষার সাহিত্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে তার অনুবাদ কর্মও এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তিনি যে কেবল অন্য ভাষার সাহিত্য বাংলায় রূপান্তর করেছেন তা নয় বরং একটি ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে আরেকটির দিকে সেতুবন্ধন তৈরি করেছেন—অত্যন্ত যত্ন, মমতা ও শিল্পবোধ দিয়ে। অনুবাদ তার কাছে কেবল ভাষান্তর নয়; এটি একটি আত্মার সংলাপ, এক জাতির অনুভবকে আরেক জাতির কাছে পৌঁছে দেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা।
চন্দন চৌধুরীর অনুবাদ-নির্বাচনে যেমন শিল্পের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে, তেমনি আছে রাজনৈতিক ও মানবিক দায়বদ্ধতা। তিনি এমন সব লেখক-কবি ও টেক্সট বেছে নিয়েছেন, যেগুলো সময়ের মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে কথা বলে, স্বাধীনতা, প্রতিরোধ, ভালোবাসা, অস্তিত্ব, ভাষা ও জাতিসত্তার প্রশ্ন। তার অনুবাদে তাই কেবল সাহিত্যের অনুবাদ নয়, সময়ের ব্যাখ্যা ও ইতিহাসের অনুরণনও শোনা যায়।
অপেক্ষাকৃত তরুণ কথাসাহিত্যিকদের উল্লেখযোগ্য হলেন মোজাফফর হোসেন। তিনি মূলত গল্পকার ও উপন্যাসিক হিসেবে পরিচিত হলেও প্রবন্ধ সাহিত্যে তার অবদান সমানভাবে সমাদৃত। তার প্রবন্ধ সাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্য হলো বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টি, সমকালীন সাহিত্যচর্চার গভীর অনুধ্যান এবং নতুন সাহিত্যতত্ত্বের প্রতি সচেতন মনোযোগ। তার প্রবন্ধ কেবল সাহিত্য সমালোচনা নয় বরং সাহিত্যের গতিধারা ও সমাজ-সংস্কৃতির টানাপড়েন বিশ্লেষণের এক শিল্পিত প্রকাশ। তার প্রবন্ধ পাঠককে জ্ঞান দেয়, আবার প্রশ্নও জাগায়। তিনি সাহিত্যকে কেবল সৃজনশীলতার সীমায় আবদ্ধ রাখেননি; বরং প্রবন্ধের মাধ্যমে সাহিত্যকে সমাজের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বিচার করেছেন। তার প্রবন্ধের ভাষা সহজ, প্রাঞ্জল এবং বিশ্লেষণধর্মী। কোথাও কোথাও রসাত্মকতা ও ব্যঙ্গও লক্ষ্য করা যায়। যুক্তি, উদাহরণ ও তুলনার মাধ্যমে তিনি প্রবন্ধকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। তিনি বাংলা ছোটগল্পের নতুন ধারা এবং কথাসাহিত্যের বিবর্তন নিয়ে গবেষণা ও প্রবন্ধ রচনা করে যাচ্ছেন। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলো হচ্ছে—‘বাংলা ছোটগল্প : তৃতীয় প্রজন্ম’, ‘সাহিত্যের নতুন মানচিত্র’, ‘প্রজন্মের কথাসাহিত্য’ ইত্যাদি।
মামুন রশীদ সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে এক উজ্জ্বল নাম। তিনি শুধু কবিতার রচয়িতা নন, এক প্রাজ্ঞ প্রাবন্ধিকও। তার সাহিত্যচর্চা দুই ধারায় বিভক্ত—কবিতায় যাপিত জীবনের অন্তরাত্মা, অনুভব ও আত্মবয়ানের দহন, আর প্রবন্ধে বিশ্লেষণধর্মী মননের অনুপম বহিঃপ্রকাশ। মামুন রশীদের লেখালেখির একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার সততা ও দায়বদ্ধতা। তিনি কোনো দৃষ্টিকোণকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেন না। বরং এক আধুনিক, মুক্তচিন্তাশীল মন নিয়ে সাহিত্যের ভেতর-বাহির পরিমাপ করেন, প্রশ্ন তোলেন, উত্তরও খোঁজেন। ইতোমধ্যে তার উল্লেখযোগ্য দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ হলো, ‘বাংলাদেশের কবিতা : সৃজনে অর্জনে’, ‘ষাটের দশক : স্বাতন্ত্র্য ও বৈভবে’।
রঞ্জনা বিশ্বাসের প্রবন্ধের ভাষা সুস্পষ্ট, সহজবোধ্য ও সংবেদনশীল। তিনি জটিল চিন্তাধারাকে সাধারণ ভাষায় প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন। যুক্তির স্রোতকে সাহিত্যিক ভাষার সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়েছেন যে পাঠক প্রবন্ধ পড়তে পড়তে জ্ঞান ও আনন্দ দুই-ই লাভ করেন। কবিতা ও ফোকলোর তার আগ্রহের বিষয়। কবিতাচর্চার পাশাপাশি ফোকলোর চর্চাকেও তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। তার গবেষণাগ্রন্থ : ‘বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা’, ‘বাংলাদেশের পালকি ও পালকিবাহক : নৃ-তাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিকধারা’, ‘বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়’, ‘সাহিত্যে বেদে সম্প্রদায়’, ‘রবীন্দ্রনাথ : কাবুলিওয়ালা, সুভা ও দালিয়া’, ‘লোকসংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘কিতুবীম : হিব্রু কবিতার সাহিত্যমূল্য’।
বাংলা সাহিত্যে কবি কুমার দীপ এক বহুমাত্রিক স্রষ্টা। তিনি কেবল কবিতা রচনায় সুনাম অর্জন করেননি, প্রবন্ধ সাহিত্যে তার অবদানও উল্লেখযোগ্য। প্রবন্ধ তার কাছে শুধু তথ্য বা অভিমত প্রকাশের মাধ্যম নয় বরং গভীর বোধ ও নান্দনিকতার সমন্বয়ে সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে নতুনভাবে দেখার একটি আয়না। তিনি সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য কবি-সাহিত্যিকদের রচনা বিশ্লেষণ করে নিজস্ব অভিজ্ঞতা, জীবনদর্শন ও আধ্যাত্মিক চিন্তা তুলে ধরছেন।
বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে কয়েকজন গদ্যকার সততা, দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষার শিল্পকৌশল দিয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করেছেন, জান্নাতুল যূথি তাদের অন্যতম। তার প্রবন্ধে প্রথমেই চোখে পড়ে ভাষার স্বচ্ছতা। তিনি অযথা অলংকারে আবদ্ধ হন না; বরং সহজ অথচ গভীর কথামালার ভেতর দিয়ে সমাজ, সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতির জটিল বিষয়গুলোকে অনায়াসে ধরিয়ে দেন। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে তার প্রবন্ধের একটি বিশেষ অবদান হলো নারীমুক্তি ও সামাজিক বাস্তবতাকে তিনি অ্যাকাডেমিক ভাষার বাইরে এনে সহজবোধ্য রূপে হাজির করেছেন। এতে সাধারণ পাঠকও বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। তার প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ : ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস : বিষয় ও প্রকরণ’ ও ‘রবীন্দ্রগল্পে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক হিসেবে নিজস্ব মর্যাদা অর্জন করেছেন। তার কবিতায় যেমন মানবিক বেদনা, স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের খোঁজ মেলে, তেমনি তার প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রতিফলিত হয় বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ, সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজ-সাহিত্যের গভীর অনুধ্যান। প্রবন্ধকে তিনি কেবল জ্ঞান বা তথ্য পরিবেশনের মাধ্যম হিসেবে নেননি; বরং এটিকে ব্যবহার করেছেন চিন্তার অস্ত্র, সময়ের প্রশ্নকে তুলে ধরার আয়না হিসেবে। তার প্রবন্ধে ভাষার স্বাতন্ত্র্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সহজ অথচ প্রাঞ্জল শব্দচয়ন, শৃঙ্খলিত বাক্যগঠন এবং বিষয়নিষ্ঠ উপস্থাপনা পাঠককে একদিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সমৃদ্ধ করে, অন্যদিকে নন্দন-আনন্দও জাগায়। ফলে পাঠক শুধু তথ্য পান না বরং লেখকের ভাবনার সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন।
বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে আঁখি সিদ্দিকা মূলত কবি হিসেবেই পরিচিত হলেও তার প্রবন্ধ সাহিত্যও সমানভাবে গুরুত্ব বহন করে। তার প্রবন্ধে যেমন কবিসুলভ কল্পনা ও ভাষার স্নিগ্ধতা আছে, তেমনি আছে গবেষণাধর্মী মনন, বিশ্লেষণী দৃষ্টি এবং বাস্তবতার সঙ্গে মেলবন্ধন। সমাজ, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মানবিক মূল্যবোধ—সবকিছুকেই তিনি প্রবন্ধে বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ফলে তার লেখায় যেমন সময়ের প্রশ্ন উঠে আসে, তেমনি চিরন্তন মানবিক অন্বেষাও প্রকাশ পায়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো—আঁখি সিদ্দিকার প্রবন্ধে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা শক্তিশালীভাবে প্রতিফলিত হয়। তিনি সমাজে নারীর অবস্থান, সংগ্রাম ও সম্ভাবনা নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়েছেন। তবে তার লেখা কেবল নারীবাদী সীমায় আবদ্ধ নয়; তিনি সমগ্র সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে একটি বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করেন। এছাড়া, সমাজ-রাষ্ট্র, ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক প্রবন্ধ স্ব-স্ব স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছেন আজিজ কাজল, ইলিয়াস বাবর, ফজলুল হক তুহিন প্রমুখ।