২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দপ্তরে সংঘটিত নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সময় বিদ্রোহীদের কমান্ডে ভিনদেশি ভাষার ব্যবহার ও অপরিচিত পোশাকের সৈনিকদের উপস্থিতির চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। বিডিআর কেন্দ্রীয় মসজিদের তৎকালীন পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমানের সাক্ষ্য অনুযায়ী, হত্যাযজ্ঞের সময় একটি পিকআপে করে আসা অস্ত্রধারী সৈনিকরা হিন্দি ও ইংরেজিতে গুলি করার নির্দেশ দিচ্ছিল। তাদের পরনের পোশাক বিডিআরের হলেও তা ছিল কিছুটা ভিন্ন এবং অপরিচিত।
গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশনের জমা দেওয়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্ত কমিশনের ৩ নম্বর সাক্ষী পেশ ইমাম সিদ্দিকুর রহমান জানান, ঘটনার সময় বিডিআরের মহাপরিচালক (ডিজি) যখন ফোনে সাহায্যের আবেদন করছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে উত্তর দিক থেকে একটি পিকআপ দরবার হলের পশ্চিম গেটে এসে থামে। সেখান থেকে অস্ত্র হাতে নেমে আসা একদল সৈনিক হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলছিল এবং গুলি চালানোর জন্য অন্যদের নির্দেশ দিচ্ছিল। এছাড়া তারা বাংলায় অফিসারদের উদ্দেশে অকথ্য গালিগালাজও করছিল।
ইমাম সিদ্দিকুর রহমান তার স্ত্রীকে জানান, ওই সৈনিকদের পোশাক বিডিআরের মতো মনে হলেও তা আসলে বিডিআরের নিজস্ব ছাপা ছিল না। দরবার হলের ভেতর থেকে এই দৃশ্য দেখার সময় দুজন বিদ্রোহী সৈনিক তাকে আলাদা করে এবং অস্ত্রের মুখে হাত উঁচু করিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয়।
বাসায় ফিরে তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন এবং স্ত্রীকে বলেন, ‘এখন বুঝতে পারছি কেন তারা আমাকে বের করে দিয়ে মসজিদে গোপন বৈঠক করত। আমি মসজিদে দুনিয়াবি কথা বলা পছন্দ করতাম না, কিন্তু তারা জোর করে বৈঠক করত।’
৬৮ ও ৬৪ নম্বর সাক্ষীর বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সকাল ১০টা ৩০ মিনিটের পর বিদ্রোহীরা চিৎকার করে অফিসারদের স্টেজের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দেয়। ১০টা ৩১ মিনিটে দক্ষিণ উইংয়ের পর্দার আড়াল থেকে তিনজন নারী কর্মকর্তাসহ অন্যরা হাত উঁচু করে বেরিয়ে আসেন। মেজর রুখসানা ওই সময় মোবাইল ফোনে তার স্বামীকে বিদ্রোহীদের দরবার হলে ঢুকে পড়ার খবর জানান।
৬৮ নম্বর সাক্ষী জানান, স্টেজের নিচে ১৫-১৬ জন বিদ্রোহী সৈনিক মুখে কাপড় বেঁধে অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। অফিসাররা বেরিয়ে আসার পর তাদের মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং র্যাংক খুলে মাটিতে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
দরবার হলের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থানরত এক বিদ্রোহী সৈনিক ৩-৪ রাউন্ড গুলি চালায়, যাতে লে. কর্নেল কায়সার ও অপর দুজন কর্মকর্তা গুলিবিদ্ধ হন। লে. কর্নেল কায়সারকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মেজর জাহিদ ও অন্য দুজন কর্মকর্তা উদ্ধার করে দরবার হলের বাইরে ডিজির গাড়ির কাছে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু এক মুখবাঁধা বিদ্রোহী অস্ত্র উঁচিয়ে বাধা দিয়ে বলে, ‘কেউ কোথাও যাবে না। এখানেই মরবে। তোরা ভেতরে যা।’ অবশেষে আহত কায়সারকে বাইরে রেখেই তাদের পুনরায় ভেতরে প্রবেশ করতে বাধ্য করা হয়।
৬৮ নম্বর সাক্ষী জানান, লে. কর্নেল কায়সার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর এক জওয়ান দৌড়ে এসে বলে, ‘মহিলা ম্যাডামদের মারিস না, ওনারা ডাক্তার।’ এরপর নারী কর্মকর্তাদের আলাদা করে দরবার হলের পশ্চিম গেটের দিকে নেওয়া হয়। সেখানে এক পিকআপে করে তাদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলেও পুরুষ কর্মকর্তাদের উঠতে বাধা দেওয়া হয়। মেজর রুখসানা ও অন্য নারী চিকিৎসকদের হাসপাতালে নামিয়ে দেওয়া হয়।
৪২ নম্বর সাক্ষীর ভাষ্যমতে, দরবার হল থেকে বের হওয়ার সময় আরেক দল অস্ত্রধারী দৌড়ে এসে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘অফিসারদের শেষ কর, একজনকেও ছাড়ব না।’ বিদ্রোহীরা অফিসারদের চোখ বেঁধে ফেলে এবং রাইফেলের বাট ও বেয়নেট দিয়ে মারধর শুরু করে। মেজর জাহিদের চোয়ালে রাইফেলের বাটের আঘাতে তার চোয়ালের হাড় ভেঙে যায় এবং প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। একপর্যায়ে এক সৈনিক তাকে চিনতে পেরে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে প্রাণ বাঁচায়।
তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসা এসব তথ্য পিলখানা হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনায় বহিরাগত শক্তির সংশ্লিষ্টতা ও নৃশংসতার এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি চলা ওই বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন প্রাণ হারান।