নয়টার ট্রেন কয়টায় যায়, অতীতের সেই দুর্নাম থেকে বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। বর্তমান সময়ে রেল ভ্রমণে যাত্রী উৎসাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই সড়কপথে যাত্রার চেয়ে রেলকে নিরাপদ হিসেবে বেছে নিচ্ছেন। নিকট অতীতে যেটি ছিল কল্পনার বাইরে।
তখন স্টেশনে রেল দাঁড়িয়ে আছে আর কিছুক্ষণের ভিতরে ছাড়বে তারপরেও লোক বলত আমার তাড়া আছে আমি হেঁটেই যাচ্ছি তুমি রেলে এসে! বিষয়টি গল্পের হলেও সেদিনের বাস্তবতায় এটি মোটেও গল্প ছিল না। সেই রেলকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলতে বড় ভূমিকা রেখেছে দক্ষিণ কোরিয়া।
রেলমন্ত্রী মন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের কণ্ঠে সেই অবদানের কথা ঝরে পড়লো। তিনি জানালেন, রেলের উন্নয়নে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার এই দক্ষিণ কোরিয়া। জাপানের পাশাপাশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করেছে দেশটি। রেল ছাড়াও নানা বিষয়ে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়া। জাপানের হাত ধরে প্রথম মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ।
রাজধানীর উত্তরা থেকে কমলাপুর লাইন-৬-এ অর্থায়ন করছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা)। চলমান এমআরটি ১ ও ৫-এ দুটি প্রকল্পেও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে দেশটি। তবে বাংলাদেশে মেট্রোরেল মানেই জাপান, এই ধারা থেকে বের হয়ে আসছে সরকার। মেট্রোরেল লাইন-৪ প্রকল্পে সম্ভাব্য অর্থায়নকারী দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ঋণ নেওয়ার আলোচনা অনেকটাই এগিয়েছে।
মেট্রোর কমলাপুর-নারায়ণগঞ্জ রুটে যুক্ত হতে যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া। আর এই কাজের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগীর খাতায় নাম লিখাতে যাচ্ছে। এ বিষয়ে গত ২৭ জুন জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইউন হি সুং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতায় বিভিন্ন উন্নয়নে দেশটির সহযোগিতার বিষয়টি উঠে আসে।
এসময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া বাংলাদেশের এক অসাধারণ উন্নয়ন ও বিনিয়োগ অংশীদার হয়ে উঠেছে। সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এবি এম সরওয়ার-ই-আলম সরকার বলেন, প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারের প্রতি তাদের সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, যা বছরে প্রায় ৩০০-৪০০মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে কালুরঘাট পয়েন্টে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল-কাম-রোডব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নের চুক্তিতে স্বাক্ষর করার জন্য ইউনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, সেতুটি চট্টগ্রাম শহরের যানজট সমস্যার সমাধান করবে। একই সাথে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং বিশেষ করে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন্য মাতারবাড়ি ( সোনাদিয়া) গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য একটি প্রশস্ত করিডোর তৈরি করবে। সবমিলিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া বর্তমানে বাংলাদেশের এক অসাধারণ উন্নয়ন ও বিনিয়োগ অংশীদার।
এদিকে রেলের উন্নয়নে দক্ষিণ কোরিয়া আগ্রহ প্রকাশ করার বিষয়টি চূড়ান্ত করতে গত ৭ জুলাই রোববার বিকেলে রেলভবনে রেলপথ মন্ত্রী জিল্লুল হাকিমের সঙ্গে দেশটির ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং-সিক এক বৈঠকে বসেন। এসময় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. হুমায়ুন কবির, বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলীসহ রেলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক বিষয়ে রেলপথমন্ত্রী মো. জিল্লুল হাকিম বলেন, দক্ষিণ কোরিয়া আমাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অংশীদার। দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিভিন্ন খাতে কারিগরি ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তিনি বলেন, সৈয়দপুরে আমাদের একটি রেলওয়ে কারখানা রয়েছে এবং রাজবাড়ীতে আরেকটি আধুনিক রেলওয়ে কারখানা নির্মাণ করা সরকারের লক্ষ্য। রেলের নতুন কোচ, ইঞ্জিন সংগ্রহ করছি। নতুন-নতুন লাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।
এদিকে নতুন ব্রিজ নির্মাণের পাশাপাশি পুরাতন ব্রিজের সংস্কার চলছে। রেলের সিগনালিং ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের কাজ চলছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে দক্ষিণ কোরিয়া এ সকল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে প্রয়োজনীয় আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।
মন্ত্রী আরো বলেন,আমরা সম্পূর্ণ বাংলাদেশকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংযুক্ত করতে চাই। তাই রেলখাতের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমরা বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। রেলমন্ত্রী এ সময় বাংলাদেশের রেল খাতে চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে কোরিয়াকে বিনিয়োগের আহ্বান জানান। এ সম্পর্কে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত পার্ক ইয়ং সিক বলেন, কোরিয়া বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়নে কাজ অংশ নিতে আগ্রহী। আশা করি, রেলখাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) তথ্য বলছে, এমআরটি-৪ রুটটি কমলাপুর থেকে শুরু হয়ে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-শনির আখড়া-সাইনবোর্ড-চট্টগ্রাম রোড দিয়ে শেষ হবে নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে। পরিকল্পিত মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য হবে ১৬ কিলোমিটার। এটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ইডিসিএফ এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএফ) থেকে ২১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার কথা রয়েছে। বাকি খরচ মানে ৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা সরকার বহন করবে। যদিও খরচের এই খতিয়ান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা। তারা বলেন, খরচের পরিমাণ বাড়তে পারে। তবে খরচের পরিমাণের বিষয়টি ঝুলে আছে। বিস্তারিত সমীক্ষার পর জানা যাবে খরচের প্রকৃত হিসাব।