পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় ২২৬ জনের বেতনের টাকা নিয়ে লুটপাট

সাবেক সরকারের বড় অর্জন ছিল পদ্মা সেতু। সেখানেই কায়েম হয় লুটপাটের রামরাজত্ব। এ যেন প্রাচীন সেই প্রবাদের মতো ওলোট-পালট করে দে মা লুটে পুটে খায়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসা শুরু। সেখানে দুর্নীতির যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা কেবল চমকে ওঠার মতো নয় বলা যেতে পারে দেশ বিক্রির নীলনকশা! দেশবাসীর স্বপ্নের এই পদ্মা সেতু থেকে কেবলমাত্র ২২৬ জনের মাস মাহিনা থেকে হাজারো কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।

পদ্মা সেতু টোল প্লাজায় টোল আদায়ের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরা এই দুটি টোল প্লাজায় চলছে লুটপাটের মহোৎসব। ২০২২ সালের ২৫ জুন বহুল কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্থাপনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর থেকেই চলে আসছে দুর্নীতির এই মহোৎসব। টোল আদায়ের জন্য কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন ও চীনের মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (এমবিইসি) পাঁচ বছরের জন্য ৬৯৩ কোটি টাকায় নিয়োগ দেয়া হয়। এই দুই টোল প্লাজা পরিচালনার জন্য ২২৬ জন স্টাফও নিয়োগ দেয়া হয়। 

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ যে বেতন নির্ধারণ করে কোম্পানীকে অর্থ ছাড় করেন। সে অনুযায়ী এ সকল স্টাফদের বেতন না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নিস্পত্তি কর্মকর্তা বরাবরে অভিযোগ করা হয়। সেই অভিযোগে এডিমিনিষ্ট্রেটিভ স্টাফ, টোল কালেক্টর এবং সুপারভাইজার এই তিন পদের কথা উল্লেখ করা হয়। তাদের দাবি অনুযায়ী চুক্তিতে একজন এডিমিনিষ্ট্রেটিভ স্টাফ এর বেতন নির্ধারণ করা হয় ৮৮ হাজার ৮০০ টাকা।  কিন্তু তাদের দেওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা। একজন টোল কালেক্টরের বেতন নিধারণ করা আছে ৭৮ হাজার ৩০০ টাকা। তারা পাচ্ছেন ১৫ হাজার টাকা। সুপারভাইজার এর বেতন নির্ধারণ করা আছে ৬০ হাজার টাকা, তাদের দেয়া হয় ২০ হাজার টাকা।

অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, এডিমিনিষ্ট্রেটিভ স্টাফের বেতন দেয়ার কথা ৮৮ হাজার ৮০০ টাকা। দেয়া হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ জনপ্রতি ৬৩ হাজার ৮০০ টাকা কম দেয়া হচ্ছে। ৯ এডিমিনিষ্ট্রেটিভ স্টাফদের বঞ্চিত করা হচ্ছে প্রতিদিন ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২০০ টাকা। যা মাস শেষে দাঁড়াচ্ছে ১ কোটি ৭২ লাখ ২৬ হাজার টাকা। এ হিসেবে বছরে লুট হচ্ছে  ২০ কোটি ৬৭ লাখ ১২ হাজার টাকা।

একজন টোল কালেক্টরের বেতন নির্ধারণ করা আছে ৭৮ হাজার ৩০০ টাকা। দেয়া হয় মাত্র ১৫ হাজার টাকা। একজনের ১৫ হাজার টাকা হলে ৩১ জনের কাছ থেকে লুটের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৯ লাখ ৬২ হাজার ৩০০ টাকা। সে হিসেবে মাসে ৫৪৮ কোটি ৮৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা আর তা বছরে ৬৫৮৬ কোটি ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকা।

অপরদিকে একজন সুপারভাইজার এর বেতন নির্ধারণ করা আছে ৬০ হাজার টাকা, তাকে দেয়া হয় ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ জন প্রতি ৪০ হাজার টাকা কম দেয়ায় নিয়োগ প্রাপ্ত ৫ জন সুপারভাইজারের কাছ থেকে লুট করা হচ্ছে ২ লাখ টাকা।  যা মাস শেষে  লুটের  পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে নেয়া ৬০ লাখ টাকা  আর বছরে সেটি ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। এই তিনটি পদ থেকেই বছরে লুটে নেয়া হচ্ছে ৬৬১৪ কোটি ২৯ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এ ভাবে ৪৫ জন স্টাফের কাছ থেকে অবৈধ ভাবে আদায় করা হলে আরো ১৮১ জনের কত হাজার কোটি হতে পারে সেটির হিসেব অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য। 

পদ্মা সেতু সাইট অফিসের বিভিন্ন সেক্টরের ৭ কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাওয়া ও জাজিরা টোল প্লাজায় নিয়োজিত স্টাফদের মধ্যে টোল কালেক্টর ও এডমিনিষ্ট্রেটিভ স্টাফদের জন্য অপরারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেস কোম্পানি ( ও এন্ড এম) অপারেটর কর্তৃক দুই প্রান্তে ভাড়া কৃত বাসায় আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে ভাড়াকৃত আবাসন ব্যবস্থায় পানি ও টয়লেটের অপর্যাপ্ততাকৃত স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আবাসনের স্বার্থে স্টাফদের গ্যাস সিলিন্ডার, বিদ্যুৎ বিল এবং ইন্টারনেট সুবিধা প্রদান করা হয়। এছাড়াও তাদের ইউনিফর্ম এবং ডিউটি চলাকালীন সময়ে স্ন্যাক প্রদান করা হয়।

জানা গেছে, টোল প্লাজায় কর্মরত টোল ম্যানেজার দ্বয়ের জন্য সার্ভিস এরিয়া-১ এবং ২ এর দুইটি মেসরুমে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে, টোল কালেক্টর ও এডমিন স্টাফদের উল্লেখিত সুবিধাদি থাকলেও টোল প্লাজা এবং সেতুর সিকিউরিটি বা সেফটি কাজের নিয়োজিত সেফটি টিম অপারেশন অ্যান্ডমেইনটেনেস অপারেটর কর্তৃক ইউনিফর্ম ব্যতীত আবাসন বা অন্য কোন সুবিধা প্রদান করা হয় না। 

ঔ সাত কর্মকর্তার স্বাক্ষরের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২২৬ জন স্টাফদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা যায় শিক্ষানবিস কাল ( তিন মাস) অতিবাহিত হওয়ার পর তাদের বেতন বৃদ্ধির কথা থাকলেও অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেস কোম্পানি তা বৃদ্ধি করা হয়নি। অধিকাংশ স্টাফদের বেতন প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতিতে তাদের নিজ নিজ নামে ব্যাংক হিসাব নম্বরে প্রদান করার কথা থাকলেও তা করা হয় না। বেশ কিছু স্টাফ নিয়োগের ক্ষেত্রে পরিমাণের বিল (বিল অফ কোয়ানটিটি) তে নির্ধারিত  যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার বিষয়টি অনুসরণ করা হয়নি। একই পদে কর্মরত বিভিন্ন স্টাফদের প্রাপ্ত পরিমাণের বিলে ( বিল অফ কোয়ানটিটি) উল্লেখিত প্রতিটি পদের বিপরীতে নির্ধারিত মাসিক বেতনের বাইরেও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেস কোম্পানী অপারেটরকে শতকরা ২০ ভাগ লভ্যাংশ এবং শতকরা ১৫ ভাগ ভ্যাট প্রদান করে থাকে। সুতরাং অপারেশন অ্যান্ড  মেইনটেনেস কোম্পানি অপারেটর কর্তৃক নিয়োগ কৃত স্টাফদের পরিমাণের বিলে (বিল অফ কোয়ানটেটি) নির্ধারিত বেতনের চেয়ে কম বেতন প্রদান করা মোটেই সমীচিন নয় বলে পদ্মা সেতু সাইট অফিসের কর্মকর্তারা মনে করেন। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক মো. মনজুর হোসেন এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন সাড়া দেন না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সহকারী বলেন, পদ্মা সেতুর সাইট অফিস থেকে একটি প্রতিবেদন সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিয়েছেন। এ প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি ও একটি বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে ঐ প্রতিবেদনের আলোর মুখে দেখেনি।

এদিকে সেতু কর্তৃপক্ষের অধিন পদ্মা সেতুর সাইট অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক মো. আমিরুর হায়দার চৌধুরী, নির্বাহী প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) এম এমান্নান, সহকারী প্রকৌশলী ইলিয়াস আহমেদ রিটু, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন ও এষ্টেট), সহকারী প্রকৌশলী (মেকারিক্যাল) মো. সিকান্দার ইব্রাহিম, সহকারী প্রকৌশলী ( টোল) রাজন চন্দ্র বিশ্বাস, সহকারী প্রকৌশলী মো. শাহীন সম্মিলিত ভাবে ৪টি মন্তব্য ও সুপারিশ প্রদান করেছেন সেতৃ কর্তৃপক্ষের বরাবরে। 

এই চারটি মন্তব্যে বা সুপারিশে তারা বলেছেন, অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেস কোম্পানির অপারেশন এ নিয়োজিত স্টাফদের বেতন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন ( কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)-জেবি এর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির বিল অফ কোয়ানটেটি ( বি ও কিউ) অনুযায়ি প্রদান করার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে।

স্টাফদের বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্যাংকিং পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের নিজ নিজ নামের ব্যাংক হিসাব প্রদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেস কোম্পানির অপারেশনকে নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন।

সম্পাদিত চুক্তির বিল অফ কোয়ানটিটি’তে উল্লেখিত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী জনবল নিয়োগের পূর্বে উক্ত জনবলের সিভি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু সাইট অফিসকে অবহিত করার বিষয়ে অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেস কোম্পানির অপারেটনকে নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে বলেও তারা সুপারিশ করেছেন।

এছাড়া পদ্মা সেতুর অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেস কোম্পানি অপারেশন তার অধীনস্ত সকল স্টাফদের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করবেন এবং উল্লেখিত বিষয়ে পদ্মা সেতু সাইট অফিসকে অবহিত করবেন মর্মে অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেস কোম্পানীর অপরেটরকে নির্দেশনা দেওয়া হতে পারে এমন সম্ভাবনার কথা তারা জানান।