ছাত্র ও জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হচ্ছে ২০২৪ সালের বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
টানা ২৩ দিনের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে ৫ আগস্ট পতন হয় সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের। এ দিন বঙ্গভবন থেকেই হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। সে সময় সঙ্গে ছিলেন তার ছোটবোন শেখ রেহানা। পরে বিশেষ বিমানে তারা ভারতে দিল্লিতে আশ্রয় নেন।
বিচারপতি, তোমার বিচার করবে যারা
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের বিপুল রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিল হাসিনা সরকার।
এরপর তার শাসনামলে আর কোনো গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন হয়নি। একতরফা নির্বাচন, ডামি প্রার্থী আর ‘নিশি রাতের ভোট’ এর মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিলেন তিনি। স্থানীয় নির্বাচনগুলোও হাসিনা সরকারের আমলে সব রকমের গ্রহণযোগ্যতা হারায়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, বামপন্থি দলসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো সে সময় নির্বাচন বর্জন করে জেল-জুলুম উপেক্ষা করে লাগাতার আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।
পাশাপাশি বাক্স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচার, স্বজন প্রীতি ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা, ব্যাংক লুটপাট, মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি, বাজার সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতি, সীমাহীন আয় বৈষম্য ছিলই।
তবে হাসিনা সরকার বরাবরই ব্যপক অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কথা প্রচার করে আসছিল। কিন্তু বাস্তবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছিল খেলাপি ঋণের বোঝা।
ফ্যাসিস্ট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও নিপীড়নের ফলে ‘বেগম পাড়া’, ‘আয়না ঘর’ কথাগুলো গণমাধ্যম ও সমাজ মাধ্যমে পরিচিতি পায়। মূলত, দুবাই-কানাডাসহ প্রবাসে লুটপাটের অর্থে গড়ে তোলা দুর্নীতিবাজদের সাম্রাজ্যকে ‘বেগম পাড়া’ অভিধায় চিহ্নিত করা হয়। আর সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগের গোপন বন্দিশালাকে বলা হয় ‘আয়না ঘর’।
আমার প্রতিবাদের ভাষা
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলছে, এসব দুঃশাসনই জনমনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ হয়ে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে দাবানল হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। যার সূচনা হয়েছিল, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, যা পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে হয়।
এর আগেও ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। সে সময়ও রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি উঠে। এছাড়া ২০১৫ সালেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট বাতিলের দাবিতে শিক্ষা আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
ছাত্রলীগ ও পুলিশের নির্মম নীপিড়নের পরেও বছর দুয়েক আগে গড়ে ওঠা কোটা সংস্কার আন্দোলন আবারো লাগাতারভাবে শুরু হয় এ বছর ১ জুলাই। মুক্তিযোদ্ধার পোষ্যদের কোটা বাতিলের প্রশ্নে ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদের ঘৃণ্য ‘রাজাকার’ বলে গাল দেয়ায় সর্বত্র খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভ।
সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে এসে স্লোগান দেন, ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার!’
এই আন্দোলনই দ্রুত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এক দফার আন্দোলন, তথা শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলনে। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের দমনের জন্য পুলিশ, র্যাব, বিজিবি’র পাশাপাশি অস্ত্রশস্ত্র-হেলমেট দিয়ে নামিয়ে দেয়া হয় ছাত্রলীগকে।
এমনকি এদিন সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের হুমকি দিয়ে এমনও বলেন, আন্দোলনকারীদের ছাত্রলীগই জবাব দেবে!
এরপরেও সারাদেশে স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, এমনকি স্কুল ছাত্ররাও রাস্তায় নেমে আসে। পাশাপাশি শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেন এক দফার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে।
শেখ হাসিনা পালায় না!
১৭ জুলাই বিক্ষোভে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। সেই ভিডিও ক্লিপ সারাদেশে বেগবান করে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন। দেশজুড়ে স্লোগান ওঠে, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি, গুলি কর!’
১৯ জুলাই কারফিউ জারি করে ওবায়দুল কাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘শুট অন সাইট’ বা দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছে!
কিন্তু এতেও দমন করা যায়নি গণজোয়ার। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি, টিয়ার, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও লাঠিপেটা চলতে থাকে। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে যথেচ্ছ গুলি করে দমন করতে চায় আন্দোলন।
অল্প কয়েক দিনে দেশজুড়ে ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় আহত হন কয়েক হাজার মানুষ। গ্রেপ্তার করা হয় ১০ হাজারের বেশি মানুষকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুমকে তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কার্যালয়ে। তাদের দিয়ে জোর করে দেয়া হয় আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা। সম্মিলিত প্রতিবাদ ও অনশনের মুখে মুক্তি পান সমন্বয়করা।
এর প্রতিবাদে সারাদেশ ক্ষোভে ফুঁসে উঠে। শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ সমর্থন জানান আন্দোলনে।
বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর একে ১৯৫২ র ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করেন। তবে সে আন্দোলনে হতাহত হয়েছিল অনেক কম।
২ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিশাল জনসমূদ্রে বৈষম্যবিরোধী ৯ দফা দাবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার পতনের এক দফায় আন্দোলন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ বা ঢাকামুখী গণযাত্রার ডাক দেওয়া হয়। কারফিউ উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে আসা হাজার হাজার ছাত্র-জনতার উপরে সেনা বাহিনী গুলি চালাতে অস্বীকার করে।
একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, একজন পুলিশ কর্মকর্তা মোবাইলে ভিডিও দেখিয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে বলছেন, ‘গুলি করি, মরে একটা…একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না!’
দেশজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের মুখে ৫ আগস্ট দুপুর নাগাদ সরকারের গদি নড়ে যাওয়ার খবর আসে। এ বেলা আড়াইটায় হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা, আশ্রয় নেন ভারতে, যদিও ১ আগস্টেই তিনি দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না!’
দৃশ্যত, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাচীন দল আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করে গেছেন।