প্রতিবাদের নামে হামলা-লুটপাট কেন ?

গাজায় ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিল থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ বেশ কয়েকটি জেলায় কেএফসি, বাটা, পিৎজা হাটসহ এক ডজনেরও বেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও লুটপাট চালায় দুবৃত্তরা।

এ ঘটনায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এছাড়া ভাঙচুর ও লুটপাটের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মহলে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। 

ঘটনাটি এমন একটি সময়ে ঘটলো যখন বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকার ঢাকায় চার দিনব্যাপী বিনিয়োগ সম্মেলন শুরু করেছে এবং বিভিন্ন দেশের কয়েকশ বিনিয়োগকারী তাতে যোগ দিতে এখানে অবস্থান করছেন। ফলে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা দেখার পর তারা সরকারের আহ্বানে কতটুকু সাড়া দেবেন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

hamla 1

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এসব ঘটনায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যে নেতিবাচক বার্তা পেয়েছে, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তার চেয়েও লজ্জার এবং দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, দেশের ভেতরে বাজার ব্যবস্থাকে আমরা সুরক্ষা দিতে পারছি না। এটা ভীতিকর।

এ ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, যারা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছেন, তারা দেশের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতার ‘প্রকৃত শত্রু’। 

ঘটনার পর পুলিশ প্রধানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু হয়েছে। ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) সকাল পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে। তবে পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটার পেছনে সরকারের দায় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

হামলাকারীদের বিষয়ে যা জানা যাচ্ছে
গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে বের হওয়া বিক্ষোভ মিছিল থেকে সোমবার সিলেট, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, খুলনা, গাজীপুরসহ আরও কয়েকটি জেলায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সিলেট মহানগরের দরগা গেইট এলাকায় অবস্থিত বহুজাতিক জুতা কোম্পানি বাটা'র একটি শোরুমে হামলার পর লুটপাট হয়। ওই ঘটনার একটি ভিডিও ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে একদল ব্যক্তি শোরুমে ঢুকে জুতা, মোজা, বেল্টসহ বিভিন্ন পণ্য লুট করে নিয়ে যেতে দেখা যায়।

সিলেট কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল হক বলেন, ওই ঘটনায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের কেউ কেউ জুতা লুটের পর তা বিক্রির জন্য ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরে প্রযুক্তির সহায়তায় তাদেরকে শনাক্ত করে আটক করা হয়।

অন্যদিকে, খুলনা মহানগরীতেও সোমবার কেএফসি, ডোমিনোজ পিৎজা এবং বাটার একটি শোরুমে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ঘটনায় ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে স্থানীয় থানা পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতদের বড় অংশই বয়সে তরুণ বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা নিজেদের ইচ্ছায়, নাকি কারও নির্দেশে হামলা-লুটপাট চালিয়েছেন, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। এছাড়া জড়িতদের গ্রেপ্তার এবং লুট হওয়ার মালামাল উদ্ধারে এখনও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

hamla 5

প্রকাশ্যে হামলা ও লুটের ঘটনা ঘটছে কেন?
মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, এর আগে মব সৃষ্টি করে বিভিন্ন স্থানে হামলা ও লুটপাটের যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোতে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এক ধরনের নির্লিপ্ততা লক্ষ্য করা গেছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে সেভাবে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে অপরাধীরা ওই ধরনের ঘটনা পুনরায় ঘটানোর সাহস পাচ্ছে।

বস্তুত গত বছরের পাঁচই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে পুলিশি ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। আবার একই সাথে মব তৈরি করে বিভিন্ন স্থানে একের পর এক হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করা হলেও ক্রমেই সেটির ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে।

'তৌহিদী জনতা' নাম দিয়ে বিভিন্ন মাজার ও দরগায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করতে দেখা যায়। সেই সঙ্গে, নারী তারকাদের শোরুম উদ্বোধন, নারী ফুটবলারদের খেলা বন্ধ করা ছাড়াও নাটক ও কনসার্ট আয়োজনের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে বাধা আসতে থাকে।

hamla 2

একইসাথে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। মানবাধিকার সংস্থা 'হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি'র হিসাবে, বাংলাদেশে গত সাত মাসে অন্তত ১১৯ জন ব্যক্তিকে বিভিন্ন অভিযোগে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

এমনকি, অর্ন্তবর্তী সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মাথায়ও ঘোষণা দিয়ে ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ভাঙতে দেখা গেছে। একই সময়ে, দেশের অন্যান্য স্থানেও শেখ মুজিবের ম্যুরাল এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে গেছে বলে মনে করেন অপরাধবিজ্ঞানীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক এবিএম নাজমুস সাকিব বলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারার কারণে মব তৈরি করে হামলার মতো ঘটনা ঘটেই চলেছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে এটা বন্ধ করা যাবে না। এসব ঘটনার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বা উদ্বেগ তৈরি হতে পারে। অন্যদিকে, জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা আরও বেড়ে যেতে পারে।

মব তৈরির ক্ষেত্রে অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা প্রচার চালাতে দেখা যাচ্ছে। সোমবারের হামলার আগে ফেসবুকে বেশ কিছু গ্রুপ এবং পেজে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক দিয়ে প্রচারণা চালাতে দেখা যায়। ওইসব প্রচারণায় সাড়া দিয়ে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে 'অতি উৎসাহী' একটি অংশ কেএফসি, বাটাসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে থাকতে পারে বলে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ।

hamla 3

কী প্রভাব পড়বে?
হামলার ঘটনার পর ব্যবসায়ীদের ইতিমধ্যেই নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সোমবার বিকেলের পর ঢাকাসহ অনেক স্থানে হামলার শিকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সীমিত করতে দেখা যায়। এভাবে মব সৃষ্টি করে একের পর এক যে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটছে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উভয়ক্ষেত্রে সেটার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বিভিন্ন জেলায় হামলার ঘটনায় বাটা উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বাটা জানায়, আমরা আমাদের দোকানে আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাই। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আমাদের অনেকগুলো দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে ও মালামাল চুরি করা হয়েছে। একটি স্বনামধন্য বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে এই ধরনের আচরণ নিন্দনীয় ও দুর্ভাগ্যজনক। নিরাপত্তা শঙ্কায় মঙ্গলবার অনেক এলাকায় দেরিতে শোরুম খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাটার কর্মকর্তারা।

এদিকে কেএফসি'র ঢাকা উত্তরা শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কোম্পানি মঙ্গলবার আমাদেরকে আউটলেট বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে।

কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাবে। বিনিয়োগের জন্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকা গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশি তো বটেই, দেশি বিনিয়োগের জন্যও এগুলো নিশ্চিত করার দিকে সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন। সূত্র: বিবিসি