সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব অনেকটাই অকার্যকর!

সরকার এবং প্রশাসনের সর্বস্তর থেকে দুর্নীতি রুখতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের বিবরণ দিতে সরকারিভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সরকারের এই নির্দেশ যথাযথভাবে পালনেরও কথাও বলা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকারে সেই ঘোষণা সময়ের প্রেক্ষিতে অনেকটাই অকার্যকর হয়ে পড়েছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ১ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দিতে হবে। পরের দিন ২ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বিস্তারিত জানান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। 

তিনি জানান, সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিবকে সভাপতি করে ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কমিটিকে আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে সম্পদ বিবরণী দাখিলের ফরম্যাট প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় সুপারিশ দিতে বলা হয়েছিল। প্রতিবেদনে সব সরকারি চাকরিজীবীকে এখন থেকে প্রতি বছর সম্পদের হিসাব দিতে হবে এমনটিই উল্লেখ করা হয়।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মধ্যে আনতে দায়িত্ব নিয়েই সম্পদের হিসাব নেওয়ার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ছক অনুযায়ী সম্পদের বিবরণী দাখিলে সময় বাড়ানো হয় কয়েক দফা। সবশেষ সময় ছিল চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি। এর পরে আর সময় বাড়ানো না হলেও ঠিক কত সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পদের বিবরণী শেষ পর্যন্ত দাখিল করলেন সে হিসাব কোনো দপ্তরে নেই।

তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথমবার একটু দেরি করে হলেও প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছেন।

ইতোমধ্যে সবার সম্পদের হিসাব চলে আসছে। হার্ডকপিতে হিসাব নেওয়ায় বিশাল একটা ভলিউম হয়েছে। এটা মেনটেইন করা কঠিন। ভবিষ্যতে যাতে এগুলোর মধ্য থেকে কারও হিসাব সহজে বের করা যায় সেজন্য সাজিয়ে রাখার কাজ চলছে- বললেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ডা. মো.নূরুল হক।

কমিটি ফরম্যাট ও সুপারিশ প্রতিবেদন দেওয়ার পর গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করেন জনপ্রশাসন সচিব। সেখানে তিনি জানান, সব সরকারি চাকরিজীবীকে এখন থেকে প্রতি বছর সম্পদের হিসাব দিতে হবে। ২০২৫ সাল থেকে প্রতিবছরের সম্পদের হিসাব ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে দিতে হবে। তবে ২০২৪ সাল পুরো না পাওয়ায় ওই বছরের হিসাব ৩০ নভেম্বরের মধ্যে দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। পরে সময় একমাস বাড়িয়ে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। শেষে হিসাব দাখিলের সময় আরও দেড় মাস অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

ভবিষ্যতে কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তখন ট্যাক্স রিটার্ন ও আমাদের কাছে দেওয়া সম্পদের হিসাব মিলিয়ে দেখতে পারবো। যেখানে গরমিল পাওয়া যাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রহমান তরফদার।

গত ২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সাংবাদিকদের বলেন, সম্পদের হিসাব জমা না দিলে খবর আছে, সোজা কথা। আইনানুগ খবর আছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে থাকা সবশেষ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৪ লাখ ৪৩ হাজার ৫১৮ জন। এর মধ্যে প্রথম থেকে নবম গ্রেডের কর্মকর্তা এক লাখ ৯০ হাজার ৯২৮ জন। দশম থেকে ১২তম গ্রেডের কর্মকর্তা দুই লাখ ৯৩ হাজার ৩৭৭ জন। এছাড়া ১৩ থেকে ১৬তম গ্রেডের কর্মচারী ৬ লাখ ২০ হাজার ৯৭২ এবং ১৭ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারী তিন লাখ ৯৩ হাজার ৫৩৮ জন। অন্য কর্মচারী ৫ হাজার ৭০৩ জন।

প্রশাসন ক্যাডার, উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদ এবং অন্য নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব জমা নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা ও তদন্ত অনুবিভাগ। সেখানে ছয় হাজারের কিছু বেশি হিসাব জমা পড়েছে। অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সম্পদের হিসাব সিলগালা খামে জমা দেন।

সরকারের আদেশ মানতে তো কর্মচারীরা বাধ্য। আমাদের মন্ত্রণালয়ের অধীন যারা রয়েছেন তাদের সবার সম্পদের হিসাব আমরা পেয়েছি। জানালেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাং শওকত রশীদ চৌধুরী।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এরপর আর সময় বাড়ানো না হলেও সম্পদের হিসাব নেওয়া হয়েছে। প্রথমবার হিসেবে বিষয়টি একটু শিথিলভাবে দেখা হয়েছে। এছাড়া হিসাব দাখিলের ক্ষেত্রে কিছু জটিলতা ও সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে সবার। এবার হিসাব দাখিলের ক্ষেত্রে সে বিষয়গুলো সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। হার্ডকপিতে সম্পদের হিসাব নেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ, তাই এটি অনলাইন করা যায় কিনা- সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে বলেও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা যায়।

‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী পাঁচ বছর পরপর সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদ বিবরণী দাখিল এবং স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির অনুমতি নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দীর্ঘদিন এ নিয়ম মানেননি, এ বিষয়ে সরকারেরও কোনো তদারকি ছিল না।

যা আছে বিধিমালায় :
‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এর ‘সম্পত্তির ঘোষণা’ উপ-শিরোনামের ১৩ বিধিতে বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাহার অথবা তাহার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার, সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বীমা পলিসি এবং মোট পঞ্চাশ হাজার টাকা বা ততোধিক মূল্যের অলংকারাদিসহ সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি সম্পর্কে সরকারের কাছে ঘোষণা দিতে হইবে এবং উক্ত ঘোষণায় নিম্নোক্ত বিষয়াদির উল্লেখ থাকিবে-
(এ) যে জেলায় সম্পত্তি অবস্থিত উক্ত জেলার নাম
(বি)পঞ্চাশ হাজার টাকার অধিক মূল্যের প্রত্যেক প্রকারের অলংকারাদি পৃথকভাবে প্রদর্শন করিতে হইবে, এবং
(সি) সরকারের সাধারণ বা বিশেষ আদেশের মাধ্যমে আরও যেই সমস্ত তথ্য চাওয়া হয়।
(২) প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ডিসেম্বর মাসে উপবিধি-(১) এর অধীনে, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে, প্রদত্ত ঘোষণায় অথবা বিগত পাঁচ বছরের হিসাব বিবরণীতে প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধি হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের নিকট দাখিল করিতে হইবে।’

যে সম্পদের হিসাব দিতে হয়েছে:
সম্পদের হিসাব দিতে গত ২২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি ও সম্পদ বিবরণী ফরম প্রকাশ করা হয়। 

সম্পদ বিবরণী ফরমে ‘ক’ অংশে সাধারণ তথ্যাবলির সঙ্গে সরকারি কর্মচারীর পরিবারের সদস্যদের (স্ত্রী/স্বামী/সন্তান) বিবরণ দিতে হয়েছে।

‘খ’ অংশে সরকারি কর্মচারী নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে দেশে-বিদেশে অর্জিত সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য উল্লেখ করবেন। স্থাবর সম্পদের মধ্যে জমি (কৃষি ও অকৃষি), ইমারত, বসতবাড়ি, ফ্ল্যাট, খামার/বাগানবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সম্পদ থাকলে সেই বিবরণ দিতে হয়েছে।

অস্থাবর সম্পদের মধ্যে অলংকারাদি, স্টকস/ শেয়ার/ডিবেঞ্চার/বন্ড/সিকিউরিটিজ, সঞ্চয়পত্র/ প্রাইজবন্ড/সঞ্চয় স্কিম, বীমা, নগদ/ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, ঋণ দেওয়া অর্থ, এফডিআর/ডিপিএস, জিপিএফ/সিপিএফ, মোটরযান (ব্যক্তিগত/বাণিজ্যিক), ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র/আসবাবপত্র, আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্য সম্পদের বিবরণ দিতে হয়েছে।

‘গ’ অংশে সরকারি কর্মচারী নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে সব তথ্য উল্লেখ করতে হয়েছে।