এক বছর আগে ঠিক এই সময়ে ঢাকার রাজপথে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছিল। ছাত্র, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ একত্র হয়ে গর্জে উঠেছিল—অবিচার, নিপীড়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রযন্ত্রের বলপ্রয়োগ, ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট, মিডিয়া সেন্সরশিপ সব কিছুকে উপেক্ষা করে তারা দাঁড়িয়েছিল সত্যের পক্ষে। পতন হয়েছিল ১৭ বছর ধরে চেপে বসা আওয়ামী স্বৈরাচারের। সেই অভ্যুত্থানের এক বছর পর প্রশ্ন উঠছে, নতুন বাংলাদেশ কি আদৌ গড়ে উঠছে, নাকি স্বপ্ন ভেঙে পড়ছে।
বিপ্লব না-কি শুধু বিক্ষোভ?
গত বছরের ৫ আগস্ট যে অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিল মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও নগর যুবসমাজ। ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাচন ব্যবস্থার অনিয়ম, দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন ও অর্থনৈতিক বৈষম্য-সব মিলিয়ে তীব্র ক্ষোভ ফুঁসে উঠেছিল। আন্দোলনকারীরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার ডাক দিয়েছিল, যেখানে থাকবে জবাবদিহিতা, মানবাধিকার, সমান সুযোগ।
কিন্তু এক বছর পর দেখা যাচ্ছে, আন্দোলনের রাজনৈতিক ভিত্তি যেমন দুর্বল ছিল, তেমনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও ছিল অস্পষ্ট। ফলস্বরূপ, গণআন্দোলনের শক্তি রাজনীতিকরণ, গ্রেপ্তার ও বিভাজনের কারণে অনেকটাই নিঃশেষ হয়ে গেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার: কতটা বদল?
আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রথমদিকে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায়, দুর্নীতির কিছু মামলার অগ্রগতি, আমলাতন্ত্রে রদবদল, বিচার বিভাগে আংশিক সংস্কার। নির্বাচনী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ফেরাতে ইলেকট্রনিক ভোটিং বাতিল করে ম্যানুয়াল ব্যালট পুনরায় চালু করা হয়।
অর্থনীতি: ভাঙনের ওপর ভারসাম্য
গণঅভ্যুত্থানের পরপরই দেখা দেয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা বাস্তবতা। বৈদেশিক ঋণ, রিজার্ভ সংকট, জ্বালানি ঘাটতি- সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতির অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। তবে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কিছুটা কমায় বৈদেশিক সহায়তা ফের আসতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক কিছু শর্তসাপেক্ষ ঋণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
তারপরও, পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কর্মসংস্থান সংকট এবং উদ্যোক্তাদের অনিশ্চয়তা কাটেনি। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের উপর চাপ দিন দিন বাড়ছে। নতুন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির যে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল, তা এখনো অধরা।
গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশ
গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম দাবির মধ্যে ছিল—স্বাধীন গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা। এক বছর পরে বলা যায়, কিছুটা শিথিলতা এসেছে। কিছু নিষিদ্ধ অনলাইন পোর্টাল ফিরেছে, কিছু সাংবাদিক মুক্তি পেয়েছেন। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নতুন নামে ফিরলেও তার সারবত্তা প্রায় আগের মতোই। সাংবাদিকরা এখনো জানেন, কোনো সীমারেখা অতিক্রম করা বিপজ্জনক।
নতুন নেতৃত্ব, পুরনো চ্যালেঞ্জ
আন্দোলনের সময় উদিত নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে ছাত্রনেতারা ও সমাজকর্মীরা—আজ বিভক্ত। কেউ যোগ দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পক্ষে থাকা রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে, কেউ আবার গেছেন একেবারে নিষ্ক্রিয়তায়। নেতৃত্বের এই ছিন্নতা ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য হুমকি স্বরূপ।
অন্যদিকে, পুরনো রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পুনর্গঠনের চেষ্টায়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ক্ষতবিক্ষত। জনগণ এখনো একটি শক্তিশালী, বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের অপেক্ষায়।
তাহলে নতুন বাংলাদেশ কত দূর?
এই প্রশ্নের উত্তর জটিল। কোনো রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন এক বছরে হয় না। তবে গত এক বছরে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তা অনেকের কাছে অপ্রতুল মনে হচ্ছে। কেউ বলছেন, এই বছর ছিল উৎসবের পর বিষণ্নতার বছর।
যদি আগামী দিনে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসে, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তবে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা সত্যিকার অর্থেই শুরু হবে। আর যদি সংস্কারের আড়ালে প্রতারণা চলতে থাকে, তাহলে গণঅভ্যুত্থান শুধু একটি তারিখ হয়ে থাকবে। যে তারিখে জনগণ স্বপ্ন দেখেছিল, কিন্তু বাস্তবতা ছিল নির্মম।
শেষ কথা
এক বছর পর নতুন বাংলাদেশ এখনো গন্তব্য নয়, বরং একটি দীর্ঘ পথের সূচনা মাত্র। প্রশ্ন হলো, পথটা কি কেউ অনুসরণ করছে? নাকি আবার হারিয়ে যাবে পুরনো ছায়ার ভেতরেই?