কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ইতোমধ্যে পুলিশ সদরদপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ে নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সোমবার (১০ অক্টোবর) থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে বাড়ানো হচ্ছে পুলিশের টহল, চেকপোস্ট ও গোয়েন্দা নজরদারি। যে কোনো ধরনের সহিংসতা ঠেকাতে মাঠে থাকবে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থা।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘিরে কোনো শঙ্কা নেই। সেনা সদস্যদের মাঠ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। গতকাল রোববার বিকেলে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন তিনি।
এদিকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, সরকারি স্থাপনা, দলীয় কার্যালয় ও পরিবহন টার্মিনালে মোতায়েন থাকবে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য। ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে বসানো হবে বাড়তি চেকপোস্ট। একই সঙ্গে সাইবার ইউনিটও সক্রিয় থাকবে, যাতে সামাজিক মাধ্যমে গুজব বা উস্কানিমূলক পোস্ট শনাক্ত করে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের চলাচল, যোগাযোগ ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত বার্তাগুলো পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
এদিকে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবি মেনে না নিলে আগামীকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে জনসভা থেকে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ সমমনা আট দল। তবে এদিন যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় কবে হবে, তা ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঘোষণা করবেন। এই দিন ঘিরে সামাজিক মাধ্যমে পলাতক অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন।
এ কর্মসূচি ঘিরে পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। শনিবার রাজধানীর রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) আয়োজিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত বিশেষ মতবিনিময় সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন।
পুলিশ সদরদপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ নানাভাবে দেশে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা চালানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সামাজিক মাধ্যমে ঢাকা লকডাউন কর্মসূচির নামে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব অপতৎপরতা দেখে জেলা পর্যায় থেকে নেতাকর্মীরা যাতে ঢাকায় আসতে না পারে, সে ব্যাপারে প্রতিটি জেলার পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। চেকপোস্ট, টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।
পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে কেউ যাতে বিশৃঙ্খল কার্যক্রম চালাতে না পারে, সেজন্য পুলিশ সতর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগ হুটহাট করে যাতে কোথাও মিছিল-মিটিং করতে না পারে, জানমালের ক্ষতি করতে না পারে, সে বিষয়ে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার দেশের অন্তত ১০টি জেলার পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৩ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে শনিবার তারা পুলিশ সদরদপ্তর থেকে নির্দেশনা পেয়েছেন। অভিযানের পাশাপাশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে চেকপোস্টের ওপর। জেলা থেকে যাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঢাকায় যেতে না পারেন, সেজন্য আজ সোমবার থেকে সড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট বসানো হবে। বিশেষ করে জেলায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে কঠোর নজরদারি থাকবে। সন্দেহজনক ব্যক্তিদের আটক করা হবে।
ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বেআইনি কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্দেশ্যে ঢাকায় গিয়ে অবস্থান করতে পারে। এটা ঠেকাতে বিভিন্ন মেস, হোস্টেল ও আবাসিক হোটেলে অভিযান চালানো হবে। এ ছাড়া নজরদারি থাকবে ঝটিকা মিছিলের দিকে। মিছিল বের হলেই ছত্রভঙ্গ এবং সবাইকে আটক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এই লকডাউন কর্মসূচি কেন্দ্র করে ঢাকায় রাজনীতির মাঠও উত্তপ্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীরাও মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। ‘লকডাউন’ ডাকা দলটির নেতাকর্মীরা মাঠে নামলে তাদের প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলো।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, সামাজিক মাধ্যমে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণা নজরে এসেছে। এসব বিষয়ে পুলিশি কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা সতর্ক আছি। এ নিয়ে নগরবাসীর আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঠেকাতে বৈঠক
আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল আগামীকাল মঙ্গলবার। কিন্তু ১৩ নভেম্বরের ঢাকা লকডাউনকে সামনে রেখে গতকাল রোববার বিকেলেই সেই সভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে দীর্ঘ সময় ১৩ নভেম্বরের কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। একই সঙ্গে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ৬৪ জেলার এসপি, থানার ওসি ও মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশ কর্মকর্তাদের কঠোর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। বৈঠক শেষে নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক কর্মকর্তা এসব তথ্য জানিয়েছেন।
পরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আগামী ১৩ নভেম্বর ‘ঢাকা লকডাউন’ নিয়ে সরকার শঙ্কিত নয়। কারণ, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম এখন নিষিদ্ধ। জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সেনাবাহিনীর ৫০ শতাংশ সদস্যকে মাঠ থেকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে না। এ সংক্রান্ত যে তথ্য ছড়িয়েছে সেটা গুজব, এরকম কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ঘোষিত আগামী ১৩ নভেম্বরের ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সরকার প্রস্তুত আছে। জনগণের জানমাল রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের অস্থিতিশীলতা হতে দেওয়া হবে না।
এর আগে গত ৫ নভেম্বর কিছু গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, সেনাবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের ৫০ শতাংশ সদস্যকে বিশ্রাম ও নির্বাচনকালীন প্রশিক্ষণের জন্য সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়া হবে। ৪ নভেম্বরের কোর কমিটির সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়।
বৈঠক সূত্রে জানা যায়, কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন ফেসবুক পেজে গণঅভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ঢাকা শহরে বিশৃঙ্খলা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের কর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। এ জন্য ফেসবুক গ্রুপ ও ভিডিও বার্তা নিয়ন্ত্রণের বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, একটা ফেসবুক গ্রুপ বন্ধ করা হলে আরও একাধিক ভুয়া ফেসবুক গ্রুপ চালু করা হচ্ছে। এ জন্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছে সরকার।