দেশে সড়ক দুর্ঘটনা কমবে কবে

‘একটি দুর্ঘটনা সারাজীবনের কান্না’—এই স্লোগান তো আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু তাতে কি কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েছে? সড়ক দুর্ঘটনা কি আদৌ রোধ করা সম্ভব হয়েছে? আমার মনে হয়, কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি। বরং ক্রমশই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাড়ছে সড়কে মৃত্যুর মিছিল। ক্ষতিগ্রস্তরা পান না ন্যায়বিচারও। নেই তেমন শাস্তির বিধানও। ফলে যার হারায় সেই কেবল বোঝে সড়ক দুর্ঘটনার কত জ্বালা। কতটা ভয়াবহ হতে পারে একেকটি সড়ক দুর্ঘটনা। তাই তো সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যু ও আহত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণে রূপ নিচ্ছে দিনদিন।

সড়ক দুর্ঘটনায় গত ৬ মাসে সারাদেশে নিহত হয়েছেন ২৭৭৮ জন। একই সময়ে ১৭ হাজার ৮২৬ জন আহত হয়েছেন। এমনটাই বলছে গবেষণা সংস্থা সেভ দ্য রোড।

এতে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারাদেশে ১৭ হাজার ৯৫৭টি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এতে ২ হাজার ৭৭৮ জন নিহত এবং ১৭ হাজার ৮২৬ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া নৌপথে ৬১৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ১৪ জন এবং আহত ৪৫১ জন। রেলপথে ৫২৬টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১৮৪ জন এবং নিহত ১৪ জন।

নিহতদের মধ্যে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, সিএনজিসহ থ্রি হুইলার ধরনের যানবাহন দুর্ঘটনায় ৭৯৫ জন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ৬৭৩ জন, বাস দুর্ঘটনায় ৮২৫ জন এবং ট্রাক-পিকআপ-লরি দুর্ঘটনায় ৪৮৫ জনের মৃত্যু হয়। সংস্থাটি আরও জানায়, প্রতি ৩ কিলোমিটারে পুলিশ বুথ বা ওয়াচ টাওয়ার স্থাপন না করা ও হাইওয়ে পুলিশসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ের পুলিশ-প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সড়কপথে ৬ মাসে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ১১৮টি। ডাকাতদের হামলায় ১০৪ জন আহত হয়েছেন। এ সময়ে নারী শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটেছে ৬১৪টি, ধর্ষণের ঘটনা দুটি।

সেভ দ্য রোডের সাতটি দাবি হলো-

১. মিরসরাই ট্র্যাজেডিতে নিহতদের স্মরণে ১১ জুলাইকে ‘দুর্ঘটনামুক্ত পথ দিবস’ ঘোষণা করতে হবে।

২. ফুটপাত দখলমুক্ত করে যাত্রীদের চলাচলের সুবিধা দিতে হবে।

৩. সড়ক পথে ধর্ষণ-হয়রানি রোধে ফিটনেসবিহীন বাহন নিষিদ্ধ এবং কমপক্ষে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ ও জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যতীত চালক-সহযোগী নিয়োগ ও হেলপার দ্বারা পরিবহণ চালানো বন্ধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

৪. স্থল-নৌ-রেল ও আকাশপথে দুর্ঘটনায় নিহতদের কমপক্ষে ১০ লাখ ও আহতদের ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ সরকারিভাবে দিতে হবে।

৫. ‘ট্রান্সপোর্ট ওয়ার্কার্স রুল’ বাস্তবায়নের পাশাপাশি সত্যিকারের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ‘ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ব্যাটেলিয়ন’ গঠন করতে হবে।

৬. সড়ক দুর্ঘটনার তদন্ত ও সাজা ত্বরান্বিতকরণের মধ্য দিয়ে সতর্কতা তৈরি করতে হবে এবং ট্রান্সপোর্ট পুলিশ ব্যাটেলিয়ন গঠনের আগ পর্যন্ত হাইওয়ে পুলিশ, নৌ-পুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা-সহমর্মিতা-সচেতনতার পাশাপাশি সব সড়কের চালক-শ্রমিক ও যাত্রীদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সব পরিবহন চালকের লাইসেন্স থাকতে হবে।

৭. ইউলুপ বৃদ্ধি, পথ-সেতুসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যাতে ভাঙা সড়ক, ভাঙা সেতু আর ভাঙা কালভার্টের কারণে আর কোনো প্রাণ দিতে না হয়।

এমন ভয়াবহতা আঁচ করা যায় শুধু গত ছয়মাসের পরিসংখ্যান দেখলেই। এমন সংখ্যা দেখলে কি আঁৎকে ওঠার কথা নয়? এ তো শুধু একটি সংস্থার প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান মাত্র। এর বাইরে আরও কত সড়ক দুর্ঘটনা থাকতে পারে, একটু কল্পনা করুন চোখ বন্ধ করে। অনেক সংবাদ হয়তো পত্রিকায় আসেনি। কিংবা প্রকাশিত হয়নি। তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না যে, সড়ক দুর্ঘটনায় কতজন মানুষ মারা যায়। গণপরিবহনের বাইরেও মোটরসাইকেল এবং ব্যক্তিগত গাড়ির দুর্ঘটনার জন্য তো নিজেকেই দায়ি করতে হবে। নিজেকেই প্রশ্ন করতে হবে। 

ফলে বলাই যায় যে, এ যেন মহামারির চেয়েও ভয়ঙ্কর। যেহেতু নানাবিধ কারণে এই দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা যাতায়াত, পরিবহন এবং রাস্তা পারাপার আমাদের জীবনের জন্য জরুরি উপাদান হয়ে উঠেছে। আমরা চাইলেও এগুলোকে বাদ দিতে পারি না। তাই মহামূল্যবান জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের উপায় খুঁজে বের করা জরুরি এবং সেটি আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। ঘটনা ঘটার পরে হইচই না করে ঘটার আগে সতর্ক থাকাটা কি আবশ্যক নয়? 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ১০ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় সড়ক দুর্ঘটনায়। এছাড়া ২০-৫০ লাখ মানুষ বিভিন্ন মাত্রায় আহত বা প্রতিবন্ধী হয়। সব বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর অষ্টম প্রধান কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। ০৫-২৯ বছর এবং আরও কম বয়সী শিশুর জন্য এটি মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। সুতরাং সচেতনতা আসতে হবে নিজের দিক থেকেই।

বিশ্বব্যাপী শতকরা ৯০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। যার সংখ্যা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় তিনগুণ বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের চিত্র অনেকটা একই রকম। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার, পাকিস্তানে প্রায় ২৭ হাজার এবং ভারতে প্রায় ৩ লাখ। তাহলে এখন আমাদের করণীয় কী? জনসচেতনতার অভাব? নাকি সদিচ্ছার অভাব? নিরাপদ সড়কের জন্য তো অনেকেই আন্দোলন করছেন। সরকারও বিভিন্ন সময়ে নানাবিধ উদ্যোগ নিয়েছে। এমনকি এ দেশের ছাত্র-জনতাও মাঠে নেমে এসেছিল। কিন্তু তাতে কি একটুও কমেছে? 

সে যাই হোক, প্রথমত নিজেকে সচেতন হতে হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পরিমাণ ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। আসলে মানসিকভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী না হওয়া অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই নিজে ড্রাইভ করুন বা বেতনভুক্ত চালকের হাতে দায়িত্ব থাকুক; উভয়েরই ঘুম চোখে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। এমনকি ঘুম চোখে মোটরসাইকেল চালানোর তো প্রশ্নই আসে না। এছাড়া সবধরনের গাড়ির ক্ষেত্রে প্রতিদিন বের হওয়ার আগে গাড়ির চাকার সংযোগ, চাকার প্রেসার, ইঞ্জিন ওয়েল, ব্রেক, গিয়ার ও এক্সিলেটর পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। একটু সময় লাগলেও কাজগুলো নিজের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

এমনকি নিজে হোক বা চালক, স্টিয়ারিংয়ে বসার আগে যথেষ্ট দক্ষ না হয়ে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামা যাবে না। দক্ষ না হয়ে রাস্তায় গাড়ি চালানো সবার জন্যই জীবন-মরণের প্রশ্ন। এভাবে নিজের বা অন্যের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারি না। এর বাইরে রাস্তায় নামলেই প্রতিযোগিতা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওভারটেকিংও বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। এভাবেই অনেকে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যান মৃত্যুর দিকে। সেটা হতে পারে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে রাস্তা পার হওয়া। এমনকি একটু ঘুরে জেব্রাক্রসিং ব্যবহার না করে সরাসরি রাস্তা পার হওয়া আরও বড় রকমের অবৈধ প্রতিযোগিতা। তাই সব ধরনের প্রতিযোগিতাই আমাদের পরিহার করতে হবে।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে মুঠোফোন বা স্মার্ট ফোন ব্যবহার না করা। এর ফলে পথচারি থেকে শুরু করে চালক সবাই মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন। তাই রাস্তায় বের হওয়ার পরপরই সব ধরনের মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকতে হবে। সেটা যেমন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সর্বোপরি সবার জন্য। জাতীয় স্বার্থেও কাজটি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

আমরা জানি, ‘যত গতি তত ক্ষতি’। তবুও কথাটি কেউই মানতেই চাই না। যখনই আমাদের হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং ওঠে; তখনই কেন জানি আমরা বেপরোয়া হয়ে উঠি। একবারের জন্যও ভাবি না, এই গতির প্রকৃত প্রাপ্তি কতটুকু ভয়াবহ হতে পারে। এই গতি কতটা ক্ষতি করতে পারে আমাকে বা আমাদের। তাই আমার প্রশ্ন হলো জীবনেও বাড়ি না ফেরার চেয়ে দেরিতে বাড়ি ফেরা অনেক উত্তম নয় কি। যে কারণে সব ধরনের গাড়ির গতিসীমা বজায় রাখা সবারই একান্ত কর্তব্য। আপনি যাত্রী, চালক কিংবা গাড়ির মালিক হোন না কেন, কখনোই অতিরিক্ত গতিকে সমর্থন করবেন না।

আরেকটি বিষয় অবশ্যই মনে রাখবেন, গাড়িতে সিট বেল্ট বাঁধা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তা এবং গাড়ি মাত্রই দুর্ঘটনা ঘটার সমূহ সম্ভাবনা। তাই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিজেকে যথাসম্ভব নিরাপদ রাখার জন্য সিট বেল্ট বাঁধাটা খুবই জরুরি। গণপরিবহনে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে সিট বেল্ট থাকার ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল চালক এবং আরোহীকে হেলমেট পরতে বাধ্য করতে হবে। সিট বেল্ট বাঁধা কিংবা মাথায় হেলমেট থাকলে দুর্ঘটনার প্রভাব কাটিয়ে অনেকটাই মাথা, মুখ এবং পুরো দেহকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হয়।

এসব পরিবহনের বাইরেও সিএনজি, রিকশা, অটোরিকশা চালককেও যথাযথ নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে হবে। কেননা বিষয়গুলো মেনে চললে অনাকাঙ্ক্ষিত সব ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আমরা চাই, সবাই নিরাপদ জীবনযাপন করি। সড়ক দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকি। প্রিয়জনের সঙ্গে আনন্দময় সময় উপভোগ করি। সারাজীবনের কান্নার চেয়ে নিরাপদ থাকা কি জরুরি নয়? 

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।