তাসের ঘরের মতো যেন একের পর এক সরকারের পতন হচ্ছে। গত কয়েক বছরে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রে একটানা অস্থিরতার ছাপ। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ আর নেপাল। সাধারণ মানুষের তীব্র অসন্তোষ, রাস্তায় অগ্নিগর্ভ বিক্ষোভ, পরিস্থিতির চরম উত্তপ্ত হয়ে ওঠা এবং শেষ পর্যন্ত দেশ চালানোর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হওয়া শীর্ষনেতাদের— তিন প্রতিবেশী দেশে আমরা দেখলাম একই চিত্র।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের কথা সবার জানা। দেশটির অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়েছিল। জীবনযাত্রার ব্যয় এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে, মানুষের পক্ষে সংসার চালানো দুরূহ হয়ে পড়েছিল। জ্বালানি তেলের তীব্র সংকটে পরিবহনব্যবস্থা প্রায় অচল। হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্যের অভাব। অসহনীয় এ পরিস্থিতিতে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। বিক্ষোভে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপক্ষেকে দেশ ছাড়তে হয়।
একই দৃশ্য এখন নেপালে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার উদ্বেগজনক। নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টি না হওয়ায় তরুণদের একটা বড় অংশ হতাশায় ভুগছে। এ হতাশা রাস্তায় বিক্ষোভের রূপ নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি— সবাইকে জনরোষের মুখে পড়তে হয়েছে।
অনেকে এ অস্থিরতার পেছনে বাইরের শক্তির হাত থাকার কথা বলছেন। নেপালের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান সত্যিই স্পর্শকাতর। চীন ও ভারত— এ দুই পরাশক্তির মাঝে থাকা দেশটির ওপর উভয়ের প্রভাব রয়েছে। কিন্তু শুধু বাইরের শক্তিকে দোষ দিলে সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের ভেতরের দিকটাও দেখতে হবে।
যদি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরও দায়িত্বশীল হতো, সরকারি কাজে স্বচ্ছতা থাকতো এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা না থাকতো, তাহলে কি পরিস্থিতি এতটা খারাপের দিকে যেত? বিক্ষোভ দেখানো গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু যখন এই বিক্ষোভ সহিংস হয়ে ওঠে এবং সরকারের পতন ঘটায়, তখন তা গণতন্ত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ। একটি দেশে সরকার পরিবর্তন হতে পারে; কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র কখনো থেমে থাকতে পারে না। সরকার পড়ে গেলে সাধারণ মানুষের কী দশা হয়, তা আমরা শ্রীলঙ্কার উদাহরণে দেখেছি।
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ও নেপালের ঘটনাগুলো আমাদের জন্য একটি বড় শিক্ষা। এ থেকে বোঝা যায়, জনগণের ধৈর্যের একটা সীমা আছে। সরকার যদি মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সেই সরকারের পতন অনিবার্য। এটি কোনো গুপ্তশক্তির চক্রান্ত নয়; বরং জনতার প্রতিক্রিয়া।
এ অঞ্চলের নেতৃত্বের উচিত এই ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলোর দিকে নজর দেওয়া। তাহলে কেবল স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এবং সাধারণ মানুষের জীবনেও ফিরে আসবে শান্তি। জনগণের ভোগান্তি ও ক্ষোভ উপেক্ষা করার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, প্রতিবেশী দেশগুলোর এ সংকট আবারও তা-ই স্পষ্ট করে দিলো।
দেশের স্থিতিশীলতার জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা, কৃষি ও স্থানীয় উৎপাদন শক্তিশালী করে মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে হবে। পাশাপাশি উচ্চ বেকারত্ব মোকাবিলায় স্কিলভিত্তিক কর্মসংস্থান, স্টার্টআপে অর্থায়ন, প্রযুক্তি উদ্যোগে সহায়তা প্রয়োজন। একইসঙ্গে করপোরেট স্বচ্ছতা, তথ্যভিত্তিক নীতি, দুর্নীতি হ্রাসে সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ, গণমাধ্যম স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
গণতন্ত্র কেবল ভোটে নয়, মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়নে, সমভাবে অংশগ্রহণে ও ন্যায়বিচারে প্রকৃত অর্থে টিকে থাকে। এরপরই আসা উচিত শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির এক নতুন সকাল।
লেখক : সাংবাদিক