উন্নয়ন-সমৃদ্ধির অন্তরায় অর্থপাচার

বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরও সমৃদ্ধ হতে পারতো, শক্তিশালী একটি ভিত্তি গড়ে উঠতো এতদিনে। যদি আমাদের দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নানাভাবে বিদেশে পাচার না হতো। আমাদের উন্নয়ন, সমৃদ্ধির চাকাকে পেছনে টেনে ধরে রেখেছে এই অবৈধ উপায়ে বিদেশে অর্থপাচার। বিশেষ করে বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগের ১৫-১৬ বছরের দুঃশাসনের সময় বিদেশে অবৈধ উপায়ে অর্থপাচারের মহোৎসব চলেছে। এটা তখন উদঘাটিত হলেও তৎকালীন সরকারের রুই-কাতলা, রাঘববোয়ালরা সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কারণে চোখের সামনে এই অবৈধ অর্থপাচারের ঘটনাগুলো ঘটলেও, তা বন্ধ করা যায়নি।

বরং খোদ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা এ বিষয়ে সাফাই গেয়েছেন। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরাও এই অর্থপাচারের কাজে সহযোগিতা করে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন। তারপরও কেউ কেউ বাধা দিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল, আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা এই পরিমাণ অর্থপাচার করেছেন। গত কয়েক বছরে অর্থপাচার বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। টাকা পাচারের বিষয়কে অর্থনীতিতে ক্ষতিকর ‘টিউমার’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থনীতি ও সম্পদের বড় অংশ এই ক্ষতিকর টিউমার চুষে নেয়। প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ৪ শতাংশের পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় থেকে যত অর্থ এসেছে, এর এক-পঞ্চমাংশ পরিমাণ অর্থ এক বছরে পাচার হয়। বিদেশি ঋণ ও বিনিয়োগ হিসেবে যত অর্থ আসে, এর দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থপাচার হয়েছে।

ব্যাংক খাত, শেয়ারবাজার, প্রকল্পের লুটপাট, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে চাঁদাবাজি, ঘুষের টাকা সংশ্লিষ্টরা বিদেশে পাচার করেছে নানা কৌশলে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ করের অভয়ারণ্য নামে পরিচিত ছোট ছোট দেশে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে। মূলত, বাড়ি কিনে এবং ব্যবসায় বিনিয়োগ করে টাকা পাচার করা হয়। দেশ থেকে কারা, কীভাবে, কোথায় টাকা পাচার হয়েছে— সেই চিত্র জানার পর সত্যিই অবাক হতে হয়। টাকা পাচারের জন্য দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের ক্রীড়নক, আমলাদের মধ্যে একধরনের অনৈতিক চক্র গড়ে উঠেছিল। ঘুষ-দুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য, ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপি ঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রকল্পের খরচ বাড়িয়ে দেখানো, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকি— এসব কর্মকাণ্ডের অর্থপাচার করা হয়।

অর্থপাচার নিয়ে গবেষণা করে এমন কিছু আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ৫৩২টি বাড়ি বা সম্পদ আছে, যার মূল্য সাড়ে ৩৭ কোটি ডলার। ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ৩ হাজার ৬০০ বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে মনোনীত হয়েছেন। ২০২৩ সালে ইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৮১৫ কোটি ডলার পাচার হয়। বিদেশে টাকাপাচার ঘটনার বেশ কয়েকটি কারণ বলা যায়। কারণগুলো হলো : রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, আইনি দায়মুক্তি এবং সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের ঘাটতি। স্বৈরাচার পতনের পর প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, শত শতকোটি ডলার চুরি করা সম্পদ করস্বর্গ ও ধনী দেশে পাচার ঠেকাতে কঠোর আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো তৈরি করা জরুরি। তিনি বলেছেন, অধিকাংশ সময় আমরা জানি, এই চুরি করা অর্থ কোথা থেকে আসছে। তবুও এটিকে আমরা বৈধ অর্থ স্থানান্তর হিসেবে মেনে নিই, কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার উদ্যোগ নেই।

বর্তমান বৈশ্বিক আর্থিকব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে দক্ষিণের দেশগুলো থেকে চুরি করা সম্পদ পাচার ঠেকাতে। এই অর্থ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে করস্বর্গ ও উন্নত দেশে, যেখানে বিভিন্ন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এসবের বৈধতা দেয়। স্বৈরাচারের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং ও আর্থিক নিয়মকানুনের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, এগুলো লুট করা অর্থ অফশোর দ্বীপপুঞ্জ ও ধনী দেশগুলোতে জমা রাখা সহজ করে দেয়।

সম্প্রতি লন্ডনে ১৮৫ মিলিয়ন (১৮ কোটি ৫০ লাখ) পাউন্ড মূল্যের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা সম্ভব হয়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে টিআই বাংলাদেশ, টিআই যুক্তরাজ্য ও স্পটলাইট অন করাপশনের (যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্বাধীন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা) যৌথ উদ্যোগে। এখানে নাগরিকসমাজ তার ভূমিকা রেখেছে এবং ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষও ব্যবস্থা নিয়েছে। যেসব দুর্নীতির মামলায় প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তিরাও অন্তর্ভুক্ত, সেসব যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ায় নিতে এবং একটি চূড়ান্ত পরিণতি দিতে হবে। যেসব দেশ তা করতে পেরেছে, তারাই দুর্নীতি ধারণা সূচকে নিজেদের স্কোর উন্নত করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন (লাখ কোটি) ডলার চুরি হয়ে যাচ্ছে। এসব অর্থ প্রতিটি দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও জলবায়ুনীতির জন্য প্রয়োজন ছিল।

বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থে দুর্নীতিবাজ নেতারা বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি কেনেন। তবে সেটিও হিমশৈলীর অংশমাত্র। এই অর্থের বড় অংশ ক্যাপিটাল মার্কেটে যায়, সেখানে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ে ও অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। যে অর্থ জনগণের কাজে লাগার কথা, তা পরিণত হচ্ছে নিরর্থক ব্যক্তিগত অর্থে। পাচার করা অর্থ ফেরত আনার চেষ্টার পাশাপাশি টাকাপাচার রোধে প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে। যদি বিদেশে অর্থপাচারের কোনো সুযোগ না থাকে, তবে পাচারকারীরা টাকা পাচারের সুযোগ পাবেন না। তাই টাকা দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। সেটি বন্ধ করার যে হাতিয়ার রয়েছে, সেগুলো আরও শাণিত করতে হবে। এ-সংক্রান্ত আইনগুলো আরও জোরালোভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ৫টি দেশের ৭টি শহরে অনুসন্ধান চালিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া ৯টি দেশে ৩৫২টি পাসপোর্টের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলো টাকার বিনিময়ে অর্জন করেছে কিছু বাংলাদেশি। দেশগুলো হচ্ছে : অ্যান্টিগা অ‍্যান্ড বারবুডা, অস্ট্রিয়া, ডমেনিকা, গ্রেনেডা, সেন্ট কিটস অ‍্যান্ড নেভিস, নর্থ মেসিডোনিয়া, মাল্টা, সেন্ট লুসিয়া ও তুরস্ক। দেশে বসে বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষে সিআইসির গোয়েন্দারা দেশগুলোতে সরেজমিন পরিদর্শন করে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। আরও অনুসন্ধান চলমান। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থপাচার করে গড়ে তোলা ৩৪৬টি সম্পত্তির সন্ধান মিলেছে। এটি তাদের অনুসন্ধানের আংশিক চিত্র। এসব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে বাংলাদেশের অনুকূলে নিয়ে আসার জন‍্য এবং অর্থপাচারে জড়িত ব্যক্তিদের সাজা নিশ্চিত করতে কাজ করছে সিআইসি। ৬টির অধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে। এ পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে, এটি ‘টিপ অব দ্য আইসবার্গ’ (হিমশৈলের চূড়া মাত্র)। তাদের কাছে এখনো প্রচুর তথ্য রয়েছে, যা উন্মোচনে আরও সময় প্রয়োজন।

এই অর্থপাচারে জড়িত ব্যক্তিরা শেখ হাসিনার আমলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেটাবেজ (তথ্যভাণ্ডার) নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ায় নিজেদের লোক বসিয়ে বহু তথ‍্য গায়েব করেছে। পতিত স্বৈরাচারী আমলে মুছে দেওয়া সেসব তথ‍্য উদ্ধারে দক্ষতা অর্জন করেছে সিআইসি। অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে দুদক, সিআইসি ও পুলিশের সিআইডিসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ দেশের সম্পদ লুট করে বিদেশে সম্পত্তি তৈরি করতে না পারে। সিআইসিকে অনুসন্ধানকাজ চলমান রাখতে হবে। যতটা সম্ভব গভীরে গিয়ে আরও দেশে অনুসন্ধান বিস্তৃত করতে হবে। যাতে দেশের সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপে সরকার সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করবে। দেশের অর্থনৈতিক খাতের এই লুটপাটকে ভয়াবহ দেশদ্রোহ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন‍্য একটি সুন্দর দেশ বিনির্মাণ করতে হলে অবশ্যই এই লুটেরাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কিছু মানুষ দেশের সম্পদ কীভাবে লুটপাট করেছে, তা জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে। সেজন‍্য সবগুলো সংস্থাকে জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলামিস্ট