বৃত্তি ও উন্নয়নে ডাকসুকে কাজ করতে হবে॥ বিল্লাল বিন কাশেম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এবং ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারপর থেকে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার যাত্রাপথে এক গুরুত্বপূর্ণ দিক তৈরি করেছে। বহু নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, লেখক, বিজ্ঞানী, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, অনেকে ঢাবির প্রাক্তন ছাত্র অ্যালামনাই হিসেবে গৌরব অর্জন করেছেন। তাদের মধ্যে অনেকে শুধু দেশের নয়; বরং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রতিষ্ঠিত।

আজকের সময়ে যখন বৈশ্বিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অ্যালামনাইদের সম্পদ— জ্ঞান, অর্থ, প্রভাব, সম্পর্ক সক্রিয়ভাবে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়, তখন আমাদের প্রয়োজন যে, ঢাবিও একই পথ অনুসরণ করুক। গবেষণা ও বৃত্তি বৃদ্ধি, পরিকাঠামো উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ— এসব লক্ষ্য নিয়ে অ্যালামনাইদের শক্তি কাজে লাগানো যেতে পারে।

 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে অ্যালামনাইদের ব্যবহার করে?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত কয়েকটি স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে :

১. অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক প্ল্যাটফর্ম : ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ, হার্ভার্ড, MIT এসব প্রতিষ্ঠান নিয়মিতভাবে প্রাক্তন ছাত্রদের জন্য ডিজিটাল নেটওয়ার্ক, রেজিস্ট্রেশন পোর্টাল, ইভেন্টস আয়োজন করে, যেগুলো তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে।

২. ফান্ডরেইজিং ও চ্যারিটি ফান্ড : অনেক প্রতিষ্ঠানে সম্মানসূচক (honorary) ও অর্থপূর্ণ (endowment) ফান্ড তৈরি করা হয়, যাতে গবেষণা, ফেলোশিপ বা অধ্যাপকদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তহবিল জোগান। উদাহরণ : হার্ভার্ডের ‘Harvard Campaign’ বা MIT-এর ‘The Campaign for a Better World’ যেখানে প্রাক্তন ছাত্ররা লাখো টাকা দান করেন এবং নতুন গবেষণা ল্যাব বানিয়ে দেন।

৩. মেন্টরিং ও ক্যারিয়ার সাপোর্ট : প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে মেন্টর বা পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন, স্টার্টআপ গাইড করেন, ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাকাডেমিয়া সংযোগে সহযোগিতা করেন।

৪. রিসার্চ পার্টনারশিপ : অ্যালামনাই প্রতিষ্ঠানে থাকা চাকরিপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিজেদের কর্মক্ষেত্র থেকে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে গবেষণা সহযোগিতা স্থাপন করেন। যেমন : Intel, Google, Microsoft-এর প্রাক্তনরা ঢাবির শিক্ষকমণ্ডলীর সঙ্গে প্রোজেক্টে যুক্ত হন।

৫. ইভেন্ট স্পন্সরিং ও ফেলোশিপ প্রদান : ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন (UCL) বা UCLA-র মতো প্রতিষ্ঠান প্রাক্তনদের উৎসাহিত করেন ‘Alumni Speaker Series’ আর ‘Alumni Fellowships’ চালু করতে।

 

ঢাবি কেন পিছিয়ে থাকবে?

ঢাকায় আমাদের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট প্রাক্তন ছাত্র রয়েছেন, যারা বর্তমানে বিদেশে বা দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল। তারা উচ্চমানের গবেষক, প্রযুক্তিবিদ, উদ্যোক্তা, নীতিনির্ধারক, শিল্প সংস্থা বা আন্তর্জাতিক সংস্থায় অবস্থান করছেন। এ সম্পদকে সক্রিয় না করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ‘ক্যাপিটাল’ নেটওয়ার্ক, তহবিল, জ্ঞান ও প্রভাবহীন থেকে যাবে।

বিশ্বের বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখায়, একবার একটি দৃঢ় অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক গড়ে উঠলে তা শিক্ষার গুণমান, গবেষণার স্তর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক প্রতিপত্তি, সবদিকে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

তাহলে কীভাবে আমরা এই সম্পদ কাজে লাগাতে পারি? নিচে কিছু সুপ্রতিষ্ঠিত পদক্ষেপ তুলে ধরা হলো :

১. অ্যালামনাই ডাটাবেস ও নেটওয়ার্ক গঠন

আন্তর্জাতিক ও জাতীয় রেজিস্ট্রি তৈরি : ঢাবির সব অনানুষ্ঠানিক জ্ঞাত, দূরবর্তী, বিদেশি প্রাক্তন ছাত্রদের তথ্য সংগ্রহ করে একটি আধুনিক, ইন্টার‍্যাক্টিভ ডাটাবেজ তৈরি করা দরকার— স্পেশালাইজড সেক্টর, অবস্থান (geolocation), বিনিয়োগ বা গবেষণার আগ্রহ, যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি উল্লেখ থাকবে।

সংযোগ উদ্দীপনা ইভেন্ট : নিয়মিত অনলাইন ও অফলাইন ইভেন্ট যেমন— ‘Alumni Homecoming’, ‘Alumni Talks’, ‘Global Reunion’ আয়োজন করা যায়। এতে প্রাক্তনরা একে অপরের সঙ্গে এবং ঢাবির বর্তমান প্রতিনিধির সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন।

সামাজিক মাধ্যম ও অফিশিয়াল প্ল্যাটফর্ম : Linkedin-এ ‘DU Alumni Group’, Facebook/Portal-এর মাধ্যমে ইভেন্ট শেয়ার, মাসিক নিউজলেটার প্রেরণ, বিশেষ সাফল্যবাহী প্রাক্তনের পরিচয় তুলে ধরা— এগুলো করা যেতে পারে।

 

২. ফান্ডরেইজিং এবং Endowment ফান্ড গঠন

ওপেন-এন্ডওয়েড ফেলোশিপ/গবেষণা ফান্ড : ঢাবির বিভিন্ন বিভাগে গবেষণার জন্য নির্দিষ্ট ‘Endowment’ ফান্ড গঠন করা যেতে পারে, যেখানে প্রাক্তন ছাত্ররা অর্থ প্রদান করে নির্দিষ্ট নাম ও উদ্দেশ্যে ফেলোশিপ ও গবেষণায় সাহায্য করবে।

পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান ও অ্যালামনাই দায় : কিছু সফল প্রাক্তন শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীরা ঋণ বা বিনিয়োগ দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল, গবেষণা ল্যাব, ডিজিটাল লাইব্রেরি বা স্মার্ট শ্রেণিকক্ষ তৈরিতে সহায়তা করতে পারেন।

Crowdfunding প্ল্যাটফর্ম : বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে বা নির্দিষ্ট ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মানুষকে সহযোগিতামূলকভাবে আনা; যেমন— ‘Sponsor a Student’, ‘Digital Library Resource Fund’, ‘Smart Classroom Initiative’ ইত্যাদি।

 

৩. গবেষণা ও কো-ক্রিয়েটিভ প্রজেক্টে অংশগ্রহণ

অ্যালামনাই-শিক্ষক রিসার্চ দল গঠন : সফল প্রাক্তন যারা চলছে গবেষণামূলক কাজ, তারা ঢাবির শিক্ষক/শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যৌথ গবেষণায় যুক্ত হতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের গবেষণা-সংক্রান্ত যৌথ প্রস্তাবনা গ্রহণ করতে পারে এবং তথ্যমূলক নেটওয়ার্ক আয়োজন করতে পারে।

শিক্ষাগত-শিল্প মাইলফলক : উদাহরণস্বরূপ, যারা বিগডেটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), পরিবেশ বিজ্ঞান, টেকনোলজি, পরিবহন বা স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে কাজ করছেন, তাদের সহযোগিতায় মেন্টরশিপ, কর্মশালা, প্রজেক্ট ল্যাব স্থাপন করা যেতে পারে।

শিক্ষা-কারিগরি অনুশীলন (Internship) সুযোগ : অ্যালামনাই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঢাবির শিক্ষার্থীদের জন্য স্টেজ/Internship প্রদান, যা তাদের হাতে বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দেয়।

 

৪. মেন্টরিং ও ক্যারিয়ার সাপোর্ট

মেন্টরিং প্রোগ্রাম : প্রাক্তন সফলরা যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ‘Alumni Mentorship Programme’ স্থাপন করার মাধ্যমে তারা ছাত্রদের CV রিভিউ, কর্পোরেট দুনিয়া বোঝানো, সিভিল সার্ভিস বা বিদেশে অ্যাডমিশনের পরামর্শ দিতে পারেন।

ক্যারিয়ার ফেয়ার ও ওয়ার্কশপ : ঢাবির ক্যারিয়ার সেন্টার অ্যালামনাইদের সাহায্যে ‘DU Career Fair’, ‘Skill Development Workshop’, ‘Entrepreneurship Bootcamp’ আয়োজন করতে পারে।

স্টার্টআপ ইনকিউবেশন : বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনোভেশন সেন্টারের সঙ্গে প্রাক্তন উদ্যোক্তাদের যুক্ত করে স্টার্টআপ, সোশ্যাল ইন্টারপ্রেনারশিপ চালানোর ক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা।

 

৫. ইভেন্ট ও শিক্ষাবিষয়ক সিরিজ আয়োজন

আন্তর্জাতিক বক্তৃতা সিরিজ : ‘Alumni Distinguished Lecture Series’ চালু করা যেতে পারে, যেখানে দেশের ও বিদেশের শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণা, কাজ, অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন।

বার্ষিক অ্যালামনাই সম্মেলন : যেমন কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডের প্রতি বছরের সম্মেলনের মতো এখানে প্রাক্তনরা গবেষণা ও আইডিয়া উপস্থাপন করতে পারেন, নতুন সংযোগ গড়ে তুলে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ে উপকৃত হতে পারেন।

অপরিচিত পাণ্ডিত্য চালু করা : নির্দিষ্ট বিষয়ের দিকে প্রাক্তন গবেষকদের বিশেষ সেমিনার দেওয়া, যেমন— ‘Climate Change and DU Alumni’, ‘Digital Future by DU Graduates’, ‘Healthcare Innovations by DU Alumni’।

 

৬. মুনাফা নয়, স্থিতিশীলতা ও আস্থা বিনির্মাণ

স্বচ্ছতা ও হিসাব-পতাকা প্রকাশ : Endowment বা দানের তহবিল ব্যবহারে স্বচ্ছতা রাখা জরুরি। নিয়মিতভাবে অডিট, রিপোর্ট, সফলতার গল্প প্রকাশ হলে অ্যালামনাইদের আস্থা বাড়ে, ভবিষ্যতেও তারা আরও অবদান রাখতে উৎসাহিত হন।

প্রেরণার পরিবেশ সৃষ্টি : ছোট বা বড়, যে কেউ সহযোগিতা করুক মৃত্তিকা নির্ধারণ বা প্রকাশনা, সাফল্য— এসব তুলে ধরলে পরবর্তীগণ অনুপ্রাণিত হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির ‘মাদার অব আধুনিটিস’, ‘ক্যাম্পাস অব লার্নিং’ নামে পরিচিত। এটির নিবিড় ঐতিহ্য, জ্ঞানের গৌরব, সামাজিক দায়িত্ব, মননশীলতা— সবই বিশাল। কিন্তু বাস্তবায়ন না হলে তখন তা শুধু নাম হয়ে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রমাণ করে দিয়েছে— যখন তারা প্রাক্তন ছাত্রদের সঙ্গে এক অর্থবহ সম্পর্ক গড়ে তোলে; অর্থ, জ্ঞান, মানবসম্পদ ও নেটওয়ার্ক সবদিকই শক্তিশালী হয়। গবেষণা পথচলা হয় আরও গতিময়, ফেলোশিপ বাড়ে, ক্যারিয়ার সান্বিধ্য সুদৃঢ় হয়, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত শিল্পায়ন দ্রুত হয়।

ঢাবি এখন এই অ্যালামনাই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারে। খোলা, সৃজনশীল, ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা দেখতে পারি— ঢাবি শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক মানে উচ্চ-গবেষণামূলক, উদ্ভাবনমুখী এবং মানবিক উৎকর্ষের একটা শিখর হয়ে উঠছে।

এই উপ-সম্পাদকীয়তে আমি কিছু রূপরেখা তুলে ধরেছি। এরপর যা দরকার— একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মপরিকল্পনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, শিক্ষক ও অ্যালামনাই— তিন পক্ষের যৌথ উদ্যোগ, একে একে বাস্তবায়ন। তবে প্রথম ধাপটা হোক : ‘অ্যালামনাইকে গুরুত্ব না দিলে, আমাদের ভবিষ্যতের গবেষণা, বৃত্তি ও উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা পূরণ অসম্ভব।’

সত্যিকারের পরিবর্তন আসে যখন আমরা শুধু প্রকাশ্যে কথা বলি না; বরং একসঙ্গে কাজ করি। ঢাবির প্রাক্তন ছাত্ররা আজ বিদেশ-দেশান্তরিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আধার। তাদের স্বাগত জানানো, সংজ্ঞায়ন করা, অংশীদারী করা— সেদিকে আমাদের নজর নিবে।

আমরা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষায় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি। শুধু চাই, একসঙ্গে কাজ করতে।

লেখক:

কবি, কলামিস্ট ও ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী