ভাঙছে মেরুদণ্ড, ডুবছে শিক্ষা ॥ কাউছার খোকন

শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে এই মেরুদণ্ডই আজ নানা সংকটে জর্জরিত। একদিকে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের দূরত্ব, কোচিং বাণিজ্য—এসব সমস্যা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমাগত দুর্বল করে তুলছে। 

প্রাচীনকাল থেকে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ছিল চরিত্র গঠন ও জ্ঞান অর্জন। শিক্ষার্থীরা শিষ্টাচার, ক্ষমাশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতার মতো গুণাবলি অর্জন করত। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষার উদ্দেশ্য সংকুচিত হয়ে শুধু ভালো ফল ও সার্টিফিকেট অর্জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

আজকের শিক্ষার্থীরা বাংলা বা ইংরেজিতে এ প্লাস পেলেও অনেকেই একটি সহজ প্যারাগ্রাফ ঠিকভাবে লিখতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ব্যর্থতার হার উদ্বেগজনক। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়। এটা স্পষ্ট করে দেয় যে, আমরা শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসেছি।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একটি বড় সংকট হলো কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনের আগ্রাসন। এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশেই নয়, জাপান, চীন, মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশেই বিদ্যমান। তবে বাংলাদেশে এই সমস্যা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।অনেক শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে ক্লাসে সম্পূর্ণ পাঠদান না করে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে আসতে বাধ্য করছেন। কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা করার সুযোগ দেওয়া হয় না। কেউ ভিন্নভাবে গাণিতিক সমস্যার সমাধান করলে তাকে নম্বর কাটা হয়, নিজে চিন্তা করে রচনা লিখলে কম নম্বর দেওয়া হয়। এতে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও স্বাধীন চিন্তাশীলতা নষ্ট হচ্ছে। কোচিং বাণিজ্যের আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো—একই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়া। এই দ্বন্দ্বের প্রভাব সরাসরি পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর।

বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশাটি আজ আর্থিক সংকট ও সামাজিক মর্যাদাহীনতার মধ্যে পড়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন অত্যন্ত কম। এই আর্থিক সংকটই অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের কোচিং ও টিউশনির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো রয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে তাদের উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষকদের এই সম্মান অনেকাংশে কমেছে। একজন শিক্ষক যখন আর্থিক দিক থেকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন, তখন তার পক্ষে সৃজনশীল ও নিবেদিতপ্রাণভাবে পাঠদান করা সম্ভব হয় না।

এদিকে, সারা দেশের অনেক সরকারি কলেজে একাদশ, দ্বাদশ, ডিগ্রি (পাস), স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর কোর্স থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি বিভাগে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ৫ থেকে ১২ জন, যা চরম অপ্রতুল। অনেক বিভাগে পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা নেই, গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই নেই—অথচ সেখানে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। এটি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে চরম অবিচার এবং শিক্ষার মানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর আগে সেখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো ও শিক্ষক নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

এক সময় ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল পবিত্র ও আত্মিক। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতায় এই সম্পর্কের গভীরতা ফুটে উঠেছে। কিন্তু বর্তমানে এই সম্পর্ক অনেকটাই দূরত্বে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে কাজ করছে নানা কারণ। কোচিং বাণিজ্য, ফলকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, অভিভাবকদের অসম্ভব প্রত্যাশা—এসবই ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ককে জটিল করে তুলছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে না, আবার কিছু শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো বুঝতে আগ্রহী নন।

একজন শিক্ষার্থীর জীবনে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সব স্তরই গুরুত্বপূর্ণ। তবে মাধ্যমিক পর্যায়টি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময়েই শিক্ষার্থীদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশ ঘটে এবং জীবনের প্রাথমিক লক্ষ্য নির্ধারিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষাই আজ সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন। এই স্তরেই কোচিং বাণিজ্য সবচেয়ে বেশি প্রকট, পরীক্ষায় নকলের প্রবণতা সর্বাধিক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের অভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান।

যুগের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাক্রমের ঘনঘন পরিবর্তন ও পরিমার্জন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক—সবার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্রতি সরকার ক্ষমতায় এসেই শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে, যা শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিকতাকে বিঘ্নিত করে। শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের আগে পর্যাপ্ত গবেষণা, প্রস্তুতি এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। কোভিড-১৯ মহামারির পর শিক্ষা খাতে দ্রুত এসেছে ডিজিটাল রূপান্তর। অনলাইন ক্লাস, ভার্চুয়াল লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ও স্মার্ট শ্রেণিকক্ষের মতো উদ্যোগ শিক্ষায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়ে শিক্ষকদের লড়তে হচ্ছে নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে—প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, সীমিত প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল অবকাঠামোর অসম প্রবেশাধিকার। গ্রামীণ ও শহুরে স্কুলের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের যে দূরত্ব, তা কেবল শিক্ষার্থীদের নয়, শিক্ষকদের মধ্যেও বৈষম্য তৈরি করছে। 

শিক্ষার এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হলো-
১. শিক্ষার উদ্দেশ্য পুনর্বিবেচনা: শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য শুধু ভালো ফল অর্জন নয়, বরং সঠিক চরিত্র ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলা হওয়া উচিত।
২. শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা: শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে তারা নিবেদিতপ্রাণভাবে পাঠদান করতে পারবেন।
৩. কোচিং বাণিজ্য বন্ধ: সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ক্লাসে যথাযথ পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।
৪. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন: শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনুপাতে পর্যাপ্ত শিক্ষক, ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি ও গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন: শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ বাড়াতে হবে। প্রতিটি বিভাগে মাসিক বা ত্রৈমাসিক সভার আয়োজন করতে হবে।
৬. কারিগরি শিক্ষার প্রসার: শুধু সনদভিত্তিক শিক্ষা নয়, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
৭. শিক্ষাক্রমের স্থিতিশীলতা: শিক্ষাক্রমে ঘনঘন পরিবর্তন এড়িয়ে যুগোপযোগী ও স্থিতিশীল শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষক যেন ডিজিটাল যুগে দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারেন, তার জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট নীতিগত সহায়তা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।

শিক্ষায় বিনিয়োগকে খরচ না ভেবে সর্বোত্তম বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, প্রতিষ্ঠান এবং সরকার—সবাইকে সমন্বিত প্রচেষ্টা নিয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই আমরা পাবো প্রকৃত শিক্ষিত, দক্ষ, পরিশ্রমী এবং নৈতিকতাসম্পন্ন জনসম্পদ। আর তখনই বাংলাদেশ পরিণত হবে বিশ্বদরবারে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতিতে।

লেখক : সাংবাদিক