কোন ছাত্রসংগঠনের আয়ের উৎস কী?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা বড় ছাত্রসংগঠনগুলো অর্থের উৎস নিয়ে পরস্পর পাল্টাপাল্টি অভিযোগের লড়াইয়ে নেমেছে। সম্প্রতি বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল এবং জামায়াত সমর্থিত ছাত্রশিবির একে অপরের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অন্যদিকে, গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতাদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির অর্থের যোগান নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।

সর্বশেষ গত সপ্তাহে ছাত্র শিবির ও ছাত্রদের নতুন দলের আয়ের উৎস নিয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারা সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন তোলার পর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিপরীতে সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জায়গায় দখল ও চাঁদাবাজি অভিযোগ রয়েছে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের বিরুদ্ধেও। একই রকমের অভিযোগ ছিল ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেও। আবার ছাত্রদলের এরকম অভিযোগকে 'অপরিপক্ক' বলে আখ্যা দিয়েছে ছাত্র শিবির।সংগঠনগুলোর আয় ব্যয়ের প্রশ্নে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টির আড়ম্বপূর্ণভাবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আয়ের উৎস নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করলেও, টাকার উৎস নিয়ে কোনো সংগঠনই তাদের আয়-ব্যয়ের তথ্য প্রকাশ করেনি। কীভাবে বিপুল ব্যয়ের রাজনৈতিক কর্মসূচির অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেসব বিবরণ কখনো জানানো হয়নি।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অতীতে যেভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ ছিল, ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে, চেহারা বা ব্যানার পাল্টালেও চাঁদাবাজির চিত্র পাল্টায়নি। সেই দায় থেকে বাঁচতে অভিযোগ আর আর কাঁদা ছোড়াছুড়ির রাজনীতি চলছে ছাত্রসংগঠনগুলোতে।

ERN 2

ছাত্রদলের আয়ের উৎস কী?
বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রদলের কমিটি থাকলেও প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালন করতে পারেনি ছাত্রলীগের দাপটে। সেই সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি, তদবির, সন্ত্রাস, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের মতো নানা অভিযোগ ছিল। ইতোমধ্যেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলে ছাত্রদল দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসগুলোতে প্রকাশ্যে রাজনীতি শুরু করে। এরপরই গত কয়েকমাসে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা চাওয়ার মতো অভিযোগও পাওয়া যায়।

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নানা ইস্যুতে ছাত্রদলের সাথে একটু একটু করে দূরত্ব বাড়তে শুরু করে ছাত্র শিবির ও গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে।

গত শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টিকে বা এনসিপিকে কারা অর্থ দিচ্ছেন ও ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিদিন তিন লাখ টাকার ইফতার আয়োজনের অর্থ কোথায় পায়, সেই প্রশ্ন করেছে ছাত্রদল। এই প্রশ্ন তোলার পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কেউ কেউ ছাত্রদলের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

দলটির সভাপতি রাকিবুল ইসলাম জানিয়েছে, তারা এই মুহূর্তে আর্থিক সংকটে বড় বাজেটের কোনো খরচ করতে পারছে না। যে কারণে তারা খুব স্বল্প পরিসরে ছোটখাটো আয়োজন করছে। এই মুহূর্তে তাদের সবচেয়ে বড় ব্যয় হচ্ছে জুলাই আগস্টের আন্দোলনে আহতের চিকিৎসায়।

আহতের চিকিৎসার ব্যয় সরকারের পক্ষ থেকে বহন করার ঘোষণা দেওয়া হলেও ছাত্রদল বলছে, মূল খরচটা দলের পক্ষ থেকেই করা হচ্ছে। আর এই বরাদ্দ আসছে দলটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তারেক রহমানের গঠিত 'বিএনপি পরিবার' নামের একটি সংগঠন থেকে। বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ক্রীড়া আয়োজন, ইফতারসহ মাহফিলসহ রাস্তায় ইফতার বিতরণ করতেও দেখা গেছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের।

এই অর্থ বরাদ্দ কোথা থেকে আসছে জানতে চাইলে ছাত্রদল সভাপতি বলেন, সাবেক নেতৃবৃন্দ ও আমরা ব্যক্তিগতভাবে খরচ করি। সাবেক নেতৃবৃন্দ যারা প্রোগ্রাম কেন্দ্রিক কন্ট্রিবিউশন করেন। মাসিক ভাবে কেউ দেয় না। কোনো কর্মসূচি হলে সাবেকরা বহন করে।

ছাত্রদলের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছাত্রলীগের লাখ লাখ অপকর্মের সাথে ছাত্রদলের অল্প কিছু বিপথগামী নেতাকর্মীর অপরাধকে সমান পাল্লায় মাপা হচ্ছে। আমাদের ছোট অন্যায়কে প্রকাশ করে ছাত্রলীগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

যদিও বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলে চাঁদাবাজির পরিস্থিতি বদলায়নি। ক্ষমতার পালাবদলে পুরনো মুখের জায়গায় নতুন মুখ এসেছে, কিন্তু চাঁদাবাজির চিত্র একই রয়েছে। ছাত্রলীগ, যুবলীগের জায়গায় বেশিরভাগ স্থানে বিএনপির স্থানীয় সংগঠন, যুবদল, ছাত্রদলের নেতাদের বিরুদ্ধে নতুন করে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

SHIBIR

কোথা থেকে আসে শিবিরের অর্থ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে গত এক যুগেরও বেশি সময় প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি ছাত্র শিবির। আগস্টের পট পরিবর্তনের পর ক্যাম্পাসগুলোতে প্রকাশ্যে ছাত্র রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরু করে ছাত্র শিবির। সাম্প্রতিক এই ছাত্র সংগঠনটিকে ঢাকায় সম্মেলনসহ বড় বড় কিছু কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে।

চলতি রমজানের শুরু থেকে ছাত্রশিবিরকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বড় পরিসরে ইফতার বিতরণ করতে দেখা গেছে। গত শুক্রবার এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পক্ষ থেকে শিবিরের আয়ের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ওই সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল নেতা নাসির উদ্দিন বলেন, শিবির প্রতিদিনই ইফতারে তিন লাখ টাকা করে ব্যয় করছে। যদি তিন লাখ করে প্রতিদিন ব্যয় করা হয়, তাহলে ৯০ লাখ টাকা ব্যয় করছেন। এই ৯০ লাখ টাকা একটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের সংগঠন হিসেবে কীভাবে উপার্জন করছে, কিংবা শিবিরের অর্থের উৎস কী তা জানতে চায় ছাত্রদল।

এই প্রসঙ্গে ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পর্ক নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, শিবিরের ইফতার খরচ নিয়ে ছাত্রদল যে অভিযোগটি তুলেছে সেটি সঠিক নয়। ছাত্রদল ধারণা নিয়ে বলেছে। আমরা বলেছি একদিনে তিন লাখ খরচ হয়েছে। আমরা যদি ৩০ দিন দেই তাহলে ৯০ লাখ টাকা খরচ হবে সেটা ধারণা। কিন্তু আমরা ৩০ দিনের ইফতার আদতে দেব কি না সেটা তো, তারা জানেই না। তারা যা বলেছে কল্পনা করে বলেছে।

তারপরও এই ছাত্র সংগঠনের এই বিপুল পরিমাণ অর্থের খরচ কোথা থেকে আসে সেই প্রশ্নও ছিল ছাত্র শিবিরের এই নেতার কাছে। জবাবে সাদ্দাম বলেন, আমাদের সকল সদস্যদের সংগঠনে দান করতে হয়। ইচ্ছা করেই তারা দেয়। আমাদের প্রাক্তনরা প্রতিমাসে নিয়মিত 'এয়ানত'(দান) করে। এর বাইরেও আমাদের প্রকাশনা সামগ্রীর বিক্রির মুনাফা থেকে সংগঠন উপকৃত হয়। যদিও শিবিরের আয়-ব্যয়ের কোন তথ্যও কখনো প্রকাশ করা হয়নি।

ERN

এনসিপির বিশাল অনুষ্ঠানে কোথা থেকে আসে অর্থ?
গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি আত্মপ্রকাশের দিনেই ঢাকায় বিশাল সমাবেশ করেছে। সেখানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ও জেলা শহর থেকে নেতা-কর্মীরা গাড়ি ভাড়া করে এসে অংশ নিতে দেখা গেছে। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে নতুন একটি সংগঠনের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান ও এর খরচ নিয়ে ছাত্রদলের সংবাদ সম্মেলন থেকে অভিযোগ করা হয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ওইদিনই সংবাদ সম্মেলন বলেন, আমাদের কারা আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছে আমরা যদি তাদের নাম প্রকাশ করি, তারা কোনোভাবে ক্ষতির শিকার হবে না সেই নিশ্চয়তা সরকারের পক্ষ থেকে দিতে হবে।

তাহলে কারা এই অর্থ বরাদ্দ করছে যাদের নাম প্রকাশে দলটির আপত্তি রয়েছে? এই প্রশ্নের জবাবে এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন বলেন, আমাদের দলে অনেক তরুণ পেশাজীবী আছেন, তারা ডোনেট করছেন। তাদের সাথে কানেকটেড অনেক শুভানুধ্যায়ী থাকেন। তাদের অনেকেও নতুন একটা উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর জন্য কাজ করছেন বা ডোনেট করছেন।

গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ একই আদর্শে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নামে নতুন একটি ছাত্র সংগঠন চালু করেছে গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ইফতার আয়োজনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে তাদের। এই ছাত্র সংগঠনটির আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হলে সংগঠনের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি স্বচ্ছতা বজায় রাখার। আমরা তেমন কোন খরচও করি না। ইফতার যারা করেছি সবার নিজের টাকা দিয়ে করছি।

জাতীয় নাগরিক পার্টি বলছে, অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে টাকা চাইবে না। বরং তারা দলের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে। যেটাকে বলা হয় 'ক্রাউড ফান্ডিং'। 

যদিও এর মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোনো কোনো নেতা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। এরই মধ্যে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া এই প্লাটফরমের রংপুরের এক নেতার এক লাখ টাকা চাঁদা দাবির ভিডিও এবং অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে থানায় অভিযোগও দায়ের করা হয়েছে। এর আগে, কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়কের বাবার বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে।

যা মনে করছেন বিশ্লেষকরা
সাম্প্রতিক ছাত্রদের বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে আর্থিক অস্বচ্ছতার এই অভিযোগগুলো নিয়ে দেশে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতির ধারা অনুসরণ করছে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো। যে কারণে গণ অভ্যুত্থানের পরও এই ক্ষেত্রে তেমন কোন পরির্বতন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চাঁদাবাজি এখন প্রকটভাবে চলছে। ক্ষমতার পরিবর্তনে শুধু ব্যানারের পরিবর্তন হয়েছে, চাঁদাবাজি সংস্কৃতির পরিবর্তন হয় নি। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার অস্ত্র হিসেবেই ছাত্রদের এক দল আরেকদলের অর্থসূত্র নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছে। এত কিছু সংস্কার হচ্ছে, কিন্তু গণতন্ত্রের মৌলিক যে প্রতিষ্ঠান সেই রাজনৈতিক দলের সংস্কার নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। যে কারণে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসছে না। নিজেরা সংশোধন না হলে রাজনীতির সংস্কৃতির পরিবর্তন সম্ভব না। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচনি তহবিল কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো চালানোর তহবিল প্রধানত আসে চাঁদাবাজির মাধ্যমে। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে রাজনীতিতে ইতিবাচক পরির্বতন আনতে আয়-ব্যয়ের হিসাবে স্বচ্ছতা আনারও পরামর্শ দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সূত্র: বিবিসি