গৃহবধূ থেকে বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীক খালেদা জিয়া 

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম বেগম খালেদা জিয়া। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং তিনবারের নির্বাচিত এই নেত্রী বর্তমানে রাজধানীর একটি হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে শুরু করে তিনি পরিণত হয়েছেন দেশের গণতন্ত্র ও ঐক্যের প্রতীকে। বিশ্বের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় একাধিকবার স্থান পাওয়া এই গণমানুষের নেত্রীর বর্তমান শারীরিক অবস্থা নিয়ে দেশজুড়ে গভীর উদ্বেগ বিরাজ করছে।

১৯৪৫ সালে দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া খালেদা জিয়ার শৈশবের ডাকনাম ছিল ‘পুতুল’। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ১৯৬০ সালে সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করার পর তিনি ‘খালেদা জিয়া’ নামে পরিচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে তিনি স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হিসেবে দৃঢ় মনোবল দেখিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে সহযোগিতা করা থেকে শুরু করে বিজয়ের আগ পর্যন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি থাকাকালীন তাঁর দৃঢ়তা তাকে আরও বলিষ্ঠ করে তোলে।

১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান হত্যার পর দলের নেতাকর্মীরা তাঁর কাছে বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানান। এরপর ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। পরের বছরই তিনি সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১৯৮৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বেই বিএনপি একটি গণমানুষের দলে পূর্ণতা লাভ করে।

১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে বেগম খালেদা জিয়া ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে জনগণের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তিনি ১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিপুল সমর্থন লাভ করেন, প্রতিটি নির্বাচনেই একাধিক আসনে জয়ী হন। তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে, ২০০৪ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিশ্বের ১০০ ক্ষমতাবান নারীর তালিকায় তিনি ১৪তম, ২০০৫ সালে ২৯তম এবং ২০০৬ সালে ৩৩তম স্থান অধিকার করেন। তিনি মোট তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

গণতান্ত্রিক আন্দোলন এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বেগম খালেদা জিয়াকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে মোট পাঁচবার গ্রেফতার হতে হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এবং ২০১৮ সালে বর্তমান সরকারের আমলে কারাবরণ।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় তিনি কারাগারে যান। প্রায় দুই বছরেরও বেশি সময় কারাবাসের পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ শর্তসাপেক্ষে তিনি মুক্তি পান। কারাগারে যাওয়ার ঘটনা স্মরণ করে তাঁর মনোবল তুলে ধরে লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা ইমরানুল হক চাকলাদার তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন যে, বিদায়কালে কান্নায় ভেঙে পড়া আত্মীয়দের তিনি দৃঢ়তার সাথে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, "কান্নার কিছু নেই... আমি ফিরে আসব। মন খারাপ কর না। শক্ত থাক।"

কারাগারে থাকাকালীনই তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। তিনি কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিস এবং আর্থ্রাইটিসসহ একাধিক জটিল রোগে ভুগছিলেন। ২০২১ সালে তিনি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হন এবং ২০২২ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে সিসিইউতে ভর্তি করতে হয়।

২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে যান এবং ১১৭ দিন পর ৬ মে দেশে ফেরেন। দেশী-বিদেশী চিকিৎসকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। গত ২৩ নভেম্বর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে দ্রুত রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

বেগম খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থার অবনতি নিয়ে দেশ-বিদেশের কোটি কোটি মানুষ উদ্বিগ্ন। শনিবার (২৯ নভেম্বর) বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলনে জানান যে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া ‘সঙ্কটাপন্ন’ অবস্থাতেই আছেন।

বিএনপি নেতা ওলামা দলের দোয়ায় তাঁর ওপর "বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-জুলুম" দায়ী বলে মন্তব্য করেন। আরেক নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় তাঁকে ‘জাতির বটবৃক্ষ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, উন্নত চিকিৎসা না পাওয়ায় আজ তাঁর এই অবস্থা। রুহুল কবির রিজভী ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে পথের কাঁটা সরাতে চক্রান্তের অভিযোগ এনে বলেন, তিনি হেঁটে হেঁটে জেলে গেলেও ফিরলেন হুইল চেয়ারে।

এছাড়াও, বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসার জন্য সব প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছেন এবং তাঁর দ্রুত আরোগ্যের জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন। তিনি বেগম জিয়াকে "গণতান্ত্রিক উত্তরণের এই সময়ে জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা" বলে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ডা: শফিকুর রহমানসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা ও তৃণমূলের কর্মীরা তাঁর সুস্থতা কামনা করেছেন।

দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষ আজ ঘরে ঘরে বসে আপসহীন এই নেত্রীর জন্য দোয়া করছেন এবং মহান আল্লাহ তাঁকে সুস্থ করে আবার জনগণের মাঝে ফিরিয়ে আনবেন—এই প্রত্যাশা রাখছেন।