যত্রতত্র আবাসন, দূষণ, দখল আর যথাযথ তদারকির অভাবে ঢাকা মহানগরীর জলাশয়গুলো ক্রমেই নিঃশেষ হতে চলছে। একই সাথে ভূ-উপরিস্থিত পানির বদলে ভূগর্ভস্থ পানির অধিক উত্তোলন ও ব্যবহারের ফলে বৃহৎ এই নগরীর পানির স্তরও আশঙ্কাজনক হারে নিচে নেমে গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাশয় কমে যাওয়ায় ঢাকা মহানগরীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, উষ্ণতা বাড়ছে। দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবেলায় সংকট তৈরি হচ্ছে। একই সাথে পানির স্তর নিচে নামায় ভবিষ্যতে বিশুদ্ধ পানির সংকটের বিষয়টিও সামনে এসেছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২৩ সালের এক ল্যান্ডসেট স্যাটেলাইট বিশ্লেষণধর্মী গবেষণা প্রতিবেদনের বরাতে বলা হয়, ‘গত ২৮ বছরে শুধু রাজধানী ঢাকা থেকেই প্রায় ৮৫ ভাগ জলাভূমি হারিয়ে গেছে। পাশাপাশি এই সময়ে নির্মাণ এলাকা বা স্থাপনা বেড়েছে ৭৫ ভাগ। অর্থাৎ সবুজ গাছপালা এবং জলাশয় ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে। এভাবে 'নীল এবং সবুজ আন্তঃসংযোগ' এর মাধ্যমে গড়ে উঠা এ মহানগরীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছে।’
ঢাকা মহানগরীর জলাশয়গুলো সম্পর্কে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিআইপির সভাপতি ড. আদিল মুহাম্মদ খান দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, ১৯৯৫ সালের গবেষণা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ঢাকার জলাশয়ের পরিমাণ ছিল ২০ শতাংশ। বর্তমানে এটি কমে ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ঢাকা মহানগরীর প্রয়োজনের তুলনায় জলাশয়ের এই পরিমাণ খুবই অপ্রতূল। বৃহৎ এই নগরীর জন্য ১০ থেকে ১৫ ভাগ জলাশয় থাকা দরকার ছিল।
নগর বিশেষজ্ঞ ড. আদিল মুহাম্মদ খান মনে করেন, 'জলাশয়গুলো নিঃশেষ হতে চলার জন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ল্যান্ড ডেভেলপার কোম্পানিগুলো দায়ী।'
ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, 'আমাদের সবার জন্যেই জলাশয়-জলাধার রক্ষা করা দরকার। এটা আমাদের দায়িত্ব। এখনও এই নগরীর যেটুকু জলাশয়-জলাধার আছে, সেটুকু আমাদের রক্ষা করতে হবে।'
জলাশয়-জলাধার রক্ষায় প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ যথাযথ প্রয়োগেরও পরামর্শ দেন এই নগর বিশেষজ্ঞ।
অপরদিকে ঢাকা মহানগরীর পানির স্তর অত্যন্ত নিচে নেমে গেছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর পানির স্তর নেমেছে ৮৫ মিটার পর্যন্ত। আর পানির এই নিচে নেমে যাওয়াতে ভবিষ্যতে ঢাকাবাসীর বিশুদ্ধ পানির সংকটের বিষয়টি সামনে এসেছে।
ঢাকা মহানগরীর পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক ড. আনোয়ার জাহিদ দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, 'আগে ঢাকা ওয়াসা আপার লেয়ার থেকে পানি তুলত। সেক্ষেত্রে টিউবওয়েলের গভীরতা হত ৪০০ থেকে ৪৫০ ফুট। আপার লেয়ারের পানি নেমে যাচ্ছে। তাই ঢাকা ওয়াসা এখন দ্বিতীয় স্তরে ৯০০ থেকে ১০০০ ফুট গভীর থেকে পানি তুলছে।'
তিনি বলেন, 'ঢাকার উপরের স্তরের পানি বর্তমানে ৭৩ থেকে ৭৪ মিটার পর্যন্ত নেমে গেছে। আর নিচের স্তরের পানি নেমে গেছে ৮৪ থেকে ৮৫ মিটার পর্যন্ত।'
ড. আনোয়ার জাহিদ আরও বলেন, 'উপরের পানির স্তর ৫০ বছর আগে ৫ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত ছিল। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার বর্তমান হারটা অনেক বেশি আশঙ্কাজনক।'
কেন ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, 'ভূগর্ভস্থ পানি পূর্বের বছর যে পরিমাণ রিচার্জ হয় তার বেশি তোলা যায় না। যদি তোলা হয় তাহলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জের তুলনায় অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়।'
তিনি বলেন, 'ঢাকায় প্রাকৃতিকভাবে ভূগর্স্থ যে পরিমাণ পানি রিচার্জ হওয়ার কথা ছিল সেটা হচ্ছে না।'
'এভাবে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির মজুদ কমে যাচ্ছে। ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে দূষণ যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে,' যোগ করেন তিনি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ঢাকার জলাশয় অনেক কমে গেছে। এখন জলাশয় শুধু সংরক্ষণ না, বৃদ্ধি করাও অতি জরুরী। এর মূল দায়িত্ব রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। রাজউক ঠিক করে নগরে কতভাগ জলাশয়-জলধারা থাকা উচিত। রাজউক এগুলোর পরিকল্পনা করে এবং বাস্তবায়নে রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করে। রাজউককে দেখতে হবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে কি-না। পরিকল্পনা বাস্তবায়নটা হলো আসল কাজ।'
ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার বিষয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরও বলেন, 'খোলা জায়গা, জলাশয় কমে গেলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। ওয়াসার ভূ-উপরিস্থিত জলভাগ থেকে, নদী থেকে পানি সংগ্রহ করার কথা। কিন্তু তারা পানি সংগ্রহ করছে ভূগর্ভস্থ থেকে।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ তালুকদার দৈনিক খবর সংযোগকে বলেন, 'জলশয়গুলো পুনরুদ্ধার দরকার। জলাশয় না থাকায় শুধু প্রাকৃতিক না, অনেক ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। উষ্ণতা বাড়ছে। আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস পানি পায় না। এসব কারণে জলাশয়-জলাধার সংরক্ষণ জরুরী। এসব বিষয়ে সিটি কর্পোরেশনকে আরও বেশি সচেষ্ট হতে হবে।'