রাজধানীর বাড্ডা-গুলশান লিংরোড। অফিসগামী যাত্রী বাসে উঠার অপেক্ষায়। এমন সময় ভিক্টোর পরিবহন নামে একটি যাত্রীবাহী বাস যাত্রী নেওয়ার জন্য থামতেই চারদিক কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল। যতক্ষণ লোকজন ওঠা-নামা করল আশপাশের পথচারীরা বাধ্য হলো নাকে হাত চেপে চলতে। এ দৃশ্য শুধু বাড্ডার নয়। পুরো রাজধানীজুড়ে এমন দৃশ্য প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে।
গাড়ির ধোঁয়ার একটা বড় উপাদান কার্বন মনোক্সাইড। কোনো জ্বালানি সম্পূর্ণ না জ্বললে কার্বন মনোক্সাইড তৈরি হয়। কার্বন মনোক্সাইড শরীরে প্রবেশ করে রক্তে মিশলে রক্তে কার্বোক্সি হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। যার পরিমাণ রক্তে বেড়ে গেলে মানুষের মৃত্যুও ঘটতে পারে। এ ছাড়া কার্বন মনোক্সাইড মস্তিস্ক, হৃদ্পিণ্ডসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর ক্ষতি করে। ওজন শরীরে প্রবেশ করলে ফুসফুসের প্রদাহ, কাশির কারণ হয়। নাইট্রোজেনের বিভিন্ন অক্সাইড ফুসফুসীয় সংক্রমণের অনাক্রমতা (ইমিউনিটি) কমিয়ে দেয়। ফলে, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জারের মতো অসুখ সহজেই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে।
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো ধোঁয়া ছাড়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রাজধানীর অনেক যানবাহনই কালো ধোঁয়া নির্গত করছে।
মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক কোনো ধোঁয়া নির্গত হলে তা ২০০ টাকা জরিমানাসহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধোঁয়ার ফলে ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। শিশুদের জন্যও ক্ষতিকর।
গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ঘুরে দেখা যায়, যানবাহনের মধ্যে বাস থেকে কালো ধোঁয়া বেশি নির্গত হয়। এর মধ্যে পুরোনো ও লক্কড়ঝক্কড় বাস থেকে হয় বেশি। মিরপুর রোডে চলাচলকারী বিকাশ, ভিআইপি, বাহনসহ বেশ কিছু বাসে এ অবস্থা দেখা যায়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সোমবার বিকাশ পরিবহনের চালককে ধোঁয়ার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এগুলা মালিকে জানে। আমার কাজ বাস চালানো।’
মোটরসাইলে চালিয়ে অফিসে যাওয়ার সময় সাংবাদিক এফ আই মাসউদের সঙ্গে প্রতিবেদকের দেখা। তার মুখে ডাবল মাক্স। এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মাসউদ বলেন, অফিসে যাওয়া আসার সময় ফিটনেসবিহীন গাড়ির কালো ধোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য ডাবল মাক্স পরছি।
সরকারি কর্মকর্তা মহসিন বাচ্চু বলেন, কালো ধোঁয়ার মধ্যে থাকে কার্বন মনোক্সাইড, ব্ল্যাক কার্বন, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড প্রভৃতি। আবার কালো ধোয়া নির্গতের সময় ধূলিকনাও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এসব পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। যা মানুষের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।
একটি বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা আনজুমান হোসেন বলেন, ফিটনেসবিহীন গাড়িই মূলত কালো ধোঁয়া ছড়ানোর প্রধানতম উৎস। এসব গাড়ির ইঞ্জিন পুরনো হওয়ায় জ্বালানি সম্পূর্ণভাবে পুড়তে পারে না। তখন সেই তেল কালো ধোঁয়ার আকারে বের হয়ে আসে। ফিটনেস যুক্ত গাড়িতে উল্টোটি হয়, তেল সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়, ফলে কালো ধোঁয়া বের হয় না।
বাস ছাড়া লেগুনা, ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাসও এ তালিকায় আছে। সোমবার সকালে কারওয়ান বাজার এলাকায় কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউতে মতিঝিলগামী নিউ ভিশন, দিশারি, বিকল্পসহ অনেক বাস থেকেই কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়।
সার্ক ফোয়ারা মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষারত নুরুন নাহার মুখে মাস্ক পরে কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছেন। ধোঁয়ার কথা বলতেই বিরক্তি নিয়ে বলেন, এমনিতেই ঢাকার বাতাস খুব খারাপ। এর ওপর প্রতিদিন এই ধোঁয়া খেতে হচ্ছে। ইনহেলার সব সময় সঙ্গে রাখি। অ্যাজমা নিয়ে এই শহরে থাকা কঠিন।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুদ্দিন বেননুর বলেন, ‘এসব গাড়ির পেট্রোলিয়াম আংশিক জ্বলে। ফলে বাতাসে বিষাক্ত পদার্থ বের হয়। মূলত সিসা-জাতীয় পদার্থ, যেটা শ্বাসতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।’
তিনি আরও বলেন, এ ধোঁয়ার প্রভাব সরাসরি শিশুদের ওপর পড়ে। মানসিক বিকাশে সমস্যা হয়। এ ছাড়া কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইডও ছড়ায়। এতে অ্যাজমা হতে পারে এবং ফুসফুসের ক্ষতি করে। তিনি আরও যোগ করেন, রাস্তায় যাদের দীর্ঘ সময় থাকা হয় অর্থাৎ ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহনশ্রমিক ও রাস্তার পাশের দোকানি, তাদের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাস্তাজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো ডিজেলে চলা মোটর ভ্যান, সময়মতো গাড়ির সার্ভিসিং না করা, বহু দিনের পুরনো গাড়ি ব্যবহার করার মতো নানা কারণে গাড়ি থেকে মাত্রাতিরিক্ত দূষিত কালো ধোঁয়া বাতাসে মেশে। অনেক সময় আবার ওভারলোড ট্রাকগুলোয় ওভারলোডের কারণে ইঞ্জিনে অতিরিক্ত চাপ পড়ার গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া বেরোয়।
এই ধোঁয়ার মধ্যে কী কী থাকে? আর তা কতটাই বা ক্ষতিকারক? এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের গবেষক তথা পরিবেশবেদদের মতে, উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হল গাড়ির ধোঁয়া। এই ধোঁয়ার মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ মাইক্রন, ওজোন, কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেনের নানা অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ছাড়াও আরও কিছু ক্ষতিকারক গ্যাসীয় উপাদান থাকে। যার মধ্যে ভোলাটাইল অর্গানিক কম্পাউন্ড (VOC) আর পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন (PAH) খুব ক্ষতিকারক।
তারা আরও জানান, পেট্রল বা ডিজেলের চেয়ে অনেক বেশি VOC বা PAH উৎপন্ন হয় জ্বালানি হিসাবে কেরোসিন ব্যবহারের ফলে। PAH-এর মধ্যে সব চেয়ে ক্ষতিকারক উপাদান হল ন্যাপথালিন আর বেনজোএপাইরিন। VOC-র মধ্যে সব চেয়ে ক্ষতিকারক বেঞ্জিন, টলুইন, জাইলিন। এই সব উপাদান গ্যাসীয় অবস্থায় আমাদের শরীরে ঢোকে। এদের কারসিনোজেনেসিটি আর মিউটাজেনেসিটি ধর্ম থাকায় এই উপাদান শরীরে প্রবেশ করলে আমাদের ক্যানসার বা মিউটেশনের কারণ হতে পারে। ন্যাপথালিন ফুসফুস ও মূত্রনালির সমস্যা তৈরি করে। বেঞ্জিন স্নায়ুতন্ত্রের নানান সমস্যার কারণ ঘটায়। PM 2.5 (পার্টিকুলেট ম্যাটার)-এ ভারী ধাতু ও বিভিন্ন হাইড্রোকার্বন থাকায় তারা প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে বড়দের ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD), ছোটদের অ্যাকিউট লোয়ার রেসপিরেটরি ইনফেকশন (ALRI) রোগের কারণ হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের সহকারী কমিশনার বলেন, মামলা ও জরিমানা নিয়মিতই হয়। বেশি সমস্যা দেখলে ডাম্পিংয়ে পাঠান। তবে বললেন, কালো ধোঁয়ার বিষয়টি তারা নজরে রাখবেন।