রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে লেবুর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। এসময় একহালি লেবু ৮০ টাকা থেকে ১০০ টাকা আবার কোথাও তা ১২০টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এই রোজায় লেবুর দাম যে বাড়বে তার আলামত গত সপ্তাহ থেকেই স্পষ্ট হচ্ছিল। তখন থেকে লেবুর হালি ২০ টাকায় উঠেছিল। কিন্তু সেই লেবু যে সপ্তাহের ব্যবধানে ১২০ টাকা স্পর্শ করবে সেটি ক্রেতারা বুঝতে পারেননি। বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মোহাম্মদপুর, কেল্লার মোড়, নিউ মার্কেটের বনলতা কাঁচাবাজার, পলাশি বাজার, হাতিরপুল এলাকায় লেবুর হালির দাম চাওয়া হয় ৮০ থেকে ১২০ টাকা। রমজান এবং গরমকে কেন্দ্র করে ভোক্তা পর্যায়ে চাহিদা বেড়েছে লেবুর।
এ অবস্থায় রোজার ঠিক আগ মুহূর্তে লেবুর দাম কয়েকগুণ বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। গত সপ্তাহেও যে লেবুর দাম ছিল ২০-৩০ টাকা হালি, সেটি এখন কিনতে সর্বনিম্ন গুনতে হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা। আর আকার-আকৃতি, জাত ও মানভেদে হালিপ্রতি লেবু ৮০, ১০০ এমনকি ১২০ টাকাও দাম চাওয়া হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর নিউমার্কেটের বনলতা কাঁচা বাজারের ভেতর ও বাইরের দোকানগুলোতে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিটি দোকানেই প্রচুর পরিমাণ বিভিন্ন আকার আকৃতি এবং জাতের লেবু এনেছেন বিক্রেতারা। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে এলাচি লেবু (লম্বা আকৃতির লেবু)। এরসঙ্গে কলম্বো ( গোল আকৃতির লেবু), কাগজী লেবুও রয়েছে। অধিকাংশ দোকানেই লেবুর দাম নির্ধারিত হচ্ছে আকৃতি ভেদে। লেবু যত বেশি বড় দামও তত বেশি। তবে যেকোনো জাতের লেবুতে সর্বনিম্ন ৬০-৮০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ১২০ টাকা দাম হাঁকা হচ্ছে।
আসন্ন রমজান উপলক্ষে নিউ মার্কেটে লেবু কিনতে এসেছেন হারুন অর রশিদ। তার কাছে একহালি লেবুর দাম চাওয়া হলো ৮০ টাকা। দামশুনে তিনি অবাক। অন্য দোকানে কম আছে কিনা যাচাই করতে গেলেন। সেখানে দাম চাওয়া হলো ১০০ টাকা হালি। অবশ্য এই দোকানের লেবুগুলো একটু বড় আর দেখে মনে হলো টাটকা। তবে দামের এই ফারাক দেখে তিনি আগের দোকানে গেলেন। সেখানে বলা হল লেবুর হালি ১০০ টাকা। আপনি একটু আগে ৮০ টাকা চাইলেন এমন প্রশ্নের জবাবে বিক্রেতার সাফ জবাব সে লেবু বিক্রি হয়ে গেছে এখন নতুন দামে কিনেছি আর সেই কেনা দামের সঙ্গে লাভ যোগ করে তাকে ১০০ টাকা বিক্রি করতে হবে। যদি আপনার পোষায় তাহলে নেন আর না পোষালে অন্যত্র দেখেন।
হারুন এই প্রতিবেদককে বলেন, দোকানদাররা আগে খরিদদারকে লক্ষী ভেবে তোয়াজ করতো। কিন্তু হাল আমলে সব কিছু বদলে গেছে। এখন খরিদদারদের কোন সম্মান নেই। দোকানি যা ইচ্ছে সেভাবেই মালে দাম হাঁকছেন দামাদামি করার কোন সুযোগ নেই। বেশি বললে বলবে, ‘না পোষালে চলে যান আপনার কাছে বিচুম না’। এই কথাটির ভিতরে কোন ভদ্রতা বা সৌজন্যতা নেই।
কথা হয় লেবু বিক্রেতা নাজিমের সঙ্গে। তিনি জানান, কি বলব বলুন। আমরা যে দামে কিনি তার উপরে একটু লাভ রেখে বিক্রি করি। বর্তমান লেবুর দাম নিয়ে তিনি বলেন,পাইকারিভাবেই বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে লেবু। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। আবার রোজা ও গরমের কারণে চাহিদা বেশি হওয়ায় বাজারে অনেক ব্যবসায়ী পর্যাপ্ত লেবু পাননি। যা লেবুর দামে প্রভাব ফেলেছে।
হাসান আলি নামের এক বিক্রেতা বলেন, আমি ৪ ধরনের লেবু এনেছি। এর মধ্যে একটি জাতের আকার সবচেয়ে বড়। সেটি কিনতে হয়েছে হালি ১০০ টাকা। লম্বা বড় জাতের লেবুর হালি ৮০ টাকা। আর ছোট-মাঝারি আকৃতির লেবুর হালি ৬০ টাকা। এটিই সর্বনিম্ন দাম। সবচেয়ে ছোট লেবুও ১৫ টাকা পিস হিসেবে পাইকারি মার্কেটে দাম চেয়েছে। আমাদের কিছুই করার নেই। প্রতিবছরই রোজার শুরুতে এরকম বাড়তি দাম থাকে।
খবির নামের আরেক বিক্রেতা বলেন, দাম যেমন বেশি তেমন মানও ভালো। প্রতিবছরই রোজার আগে দাম এরকম বেড়ে যায়। তাছাড়া এখন গরম শুরু হয়েছে শরবতের জন্যও ব্যাপক চাহিদা। পাইকারি বাজারেই বাড়তি দাম দিয়ে আমাদের কিনতে হচ্ছে। গত সপ্তাহেও যেই লেবু ৪০ টাকা হালি ছিল সেটি এখন ৮০-৯০ টাকার নিচে কেনা যাচ্ছে না। রোজার মাস ধরে দাম এমন চড়া থাকবে। আবার পাহাড়ি লেবু বাজারে নামলে তখন দাম হয়তো কিছুটা কমবে।
লেবুর বাড়তি দাম নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেছেন ক্রেতারাও। আব্দুল্লাহ শিকদার নামে একজন ক্রেতা নিজের ক্ষোভ এভাবেই ঝাড়লেন। বাজারে কোন কিছুর দামই নিয়ন্ত্রণে নেই। যাই কিনতে চাই দোকানদার বলে দাম বাড়তি। আজকে লেবুর বাজারও তেমনি বাড়তি বলছে দোকানদার। কিন্তু বাজারে আমদানি প্রচুর। এমন আমদানির ভিতরেও লেবুর দাম বাড়ানো খুবই রহস্যজনক। বাজার সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় কোনভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সরকার দফায় দফায় শুল্ক ট্যাক্স কমালেও তার সুফল সাধারণ ক্রেতারা পাচ্ছেন না। উল্টো দাম বাড়ছে। আমরা এমন অরাজকতা থেকে কবে মুক্তি পাব আর আদৌ মুক্তি পাব কিনা সেটি অনিশ্চিত।
বাজার করতে আসা শিউলি নামের এক গার্মেন্টস শ্রমিক যা বললেন সেটি সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের চিত্রটি উলঙ্গ করছে। তিনি জানালেন, গার্মেন্টসে চাকরি করি বেতন খুবই সীমিত তারপরে অনিয়মিত। সামনে রমজান মাস। এখনই বাজার চোখ রাঙাচ্ছে। এবার মনে হয় না খেয়েই রোজা থাতে হবে। চলতি সময়ে গার্মেন্টেসে অস্থিরতা এমনিতেই আতঙ্কিত করে তুলেছে। এসময় কথা হয় এস এম শুভ নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবীর সঙ্গে।
তিনি জানান, গতকাল রোজার বাজার করতে এসেছি। আগামী শনিবার দিন থেকে রোজা এমনটিই জানতে পেরেছি। আমার কাছে যা টাকা ছিল তা দিয়ে খুব কমই জিনিষই কিনতে পেরেছি। ইফতারির জন্য সরবত করব বলে ভেবেছি। এজন্য লেবু লাগবে। কিন্তু বাজারে এসে হতাশ। এভাবে দাম বাড়লে আমাদের পক্ষে লেবু কেনা সম্ভব নয়।
এদিকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, পরবর্তী ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল হবে। এরপর ভোজ্যতেল পরিশোধন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে বাজারে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হচ্ছে। তাই রমজানে বাজারে ভোজ্যতেল সরবরাহে কোনও সংকটের আশঙ্কা নেই। তবে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ এখনও স্বাভাবিক হয়নি।
সূত্র জানিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার বেশি পরিমাণে সয়াবিন তেল আমদানি করা হলেও রমজান শুরুর আগেই বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরির অভিযোগ উঠেছে। দোকানে দোকানে ঘুরেও সহজে মিলছে না সয়াবিন তেল। ভোজ্যতেল নিয়ে রাজধানীর মহল্লাগুলোতেও চলছে একই ধরনের সংকট। কোথাও সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও দিতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। বাজারে এখন প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ২১০ টাকায় ঠেকেছে।
জানা গেছে, ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো একজোট হয়ে সরকারের কাছে বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু সরকার রাজি হয়নি। ফলে ব্যবসায়ীরা কৌশলে মার্কেটে সয়াবিন তেলের সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ ভোক্তাদের। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ করা হচ্ছে না। তবে সরকারের কাছে আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২৫ ফেব্রুয়ারির পর বাজার থেকে ভোজ্যতেলের সংকট দূর হবে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) খুচরা দামের তথ্য অনুসারে, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন ১৭৫ থেকে ১৭৬ টাকা। যা গত মাসের তুলনায় প্রায় এক শতাংশ বেশি। গত বছরের তুলনায় সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে ২ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের রুটিন দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রহিম খান বলেন, বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট কেটে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি মনিটর করা হচ্ছে। আর রমজানকে কেন্দ্র করে অনৈতিক মুনাফার আশায় দাম বাড়িয়ে বিক্রি করার সুযোগ নাই। আমাদের একাধিক মনিটরিং টিম বাজারে কাজ করছে।