ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে জমে উঠেছে ঈদ বাজার। ঈদকে কেন্দ্র করে দেশে বাণিজ্য হয় কমবেশি পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার। গত কয়েক বছরে দোকান মালিক সমিতির হিসাব বলছে এমনই। এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন পরবর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি দেশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ঈদকেন্দ্রিক ব্যয় এবার কমবে। তবে বেচাকেনা একেবারে খুব কম হবে এমনটিও নয়।
এবার ঈদের বেচাকেনা কেমন- এ প্রশ্নের জবাব একেক ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে একেক রকম। কেউ বলছেন ভালো, কেউ বলছেন খুব খারাপ। কেউ আবার জমজমাট বেচাকেনা করেছেন, কেউ আছেন শেষ মুহূর্তে ভালো কিছুর অপেক্ষায়। তবে বেশির ভাগ ক্রেতা বলেছেন পোশাকের দাম চড়া। তাই সাধ ও সাধ্যের টানাপোড়েন কেনাকাটা সীমিত করেছেন ক্রেতারা।
বিক্রেতারা বলছেন, যে পরিমাণে ক্রেতা সমাগম হয়েছে, ওই পরিমাণের বিক্রি নেই। মিরপুর ১১ নম্বরের মোহাম্মদীয়া মার্কেটের খাদিজা কালেকশনে স্ত্রীর জন্য থ্রি পিস কিনতে এসে দাম শুনে ফিরে গেছেন রাকিব বিন কুদ্দুস। নতুন বিয়ে করে রেসপনসিবিলটি বেড়েছে। চাকরি করেন একটি টিভি চ্যানেলে। তিনি দোকানে এসে দাম জানতে চাইলে বিক্রেতা নাদিম মিয়া বলেন, সব তিনের (তিন হাজার) উপরে; তিনের নিচে কিছু নাই। এরপর স্ত্রীকে নিয়ে অন্য দোকানের দিকে চলে যান রাকিব। এসময় তার কাছে জানতে চাওয়া হয় কেন তিনি ফিরে যাচ্ছেন। জবাবে রাকিব বলেন, যে জিনিস তারা দেখাচ্ছে সেটি খুবই নিম্নমানের। কিন্তু দামের বেলায় তারা কোন ছাড় দিচ্ছেন না। আমার মনে হচ্ছে তারা বেশ কয়েকগুণ লাভ করছেন। নতুন বউয়ের সামনে তাই বাদ প্রতিবাদ করতে পারছিনা অতএব নিরবেই চলে যাচ্ছি।
বিভিন্ন দোকানে পোশাক নিয়ে দর কষাকষি করতে দেখা গেল ক্রেতাদের। তবে বিক্রেতারা বললেন, ‘যে পরিমাণে ক্রেতা সমাগম হয়েছে, ওই পরিমাণের বিক্রি নেই।দর কষাকষিতে পেরে না উঠে মার্কেটে আসা অনেককে খালি হাতে ফিরে যেতেও দেখা গেল। কিছু ক্রেতা আবার সীমিত কেনাকাটা করে ঘরে ফিরেছেন। মিরপুর ১০ নম্বরের হোপ প্লাজার রিদি ফ্যাশনে মেয়ের জন্য ওয়ান পিস কিনতে দরদাম করছিলেন হালিমা আক্তার। কাপড়ের দাম ৮০০ টাকা শুনে পোশাক না কিনেই তিনি ফিরে যান।’
হালিমা বলেন, ‘এই মার্কেটেই কাপড়ের দাম সবচেয়ে কম। এখানেই যদি এমন হয়, অন্য জায়গায় কেমন হবে বুঝতেই পারছেন। সব জিনিসের দাম বেশি, এ কারণে আয়ে আর কুলাইতে পারি না। নিজেদের জন্য কিছু কিনিনি। এবার মনে হয় মেয়ের জন্যও কিছু কিনতে পারব না। ’তিনি বলেন, ‘এবার ভ্যান প্লাজা থেকেই কিনতে হবে।’
দোকানের সেলসম্যান রাজু আহমেদ বলেন, এক বছরের ব্যবধানে অর্ধেকের বেশি ক্রেতা হারিয়েছেন তারা। পাবলিকের কাছে টাকা নেই তারপরে যেসব কাস্টমার আসছে, তারা কেবলই ঘাঁটাঘাঁটি করছে। আমাদের এখানে সারাজীবন একই দাম থাকে। ঈদের জন্য বাড়ছে, এমন হলেও একটা কথা ছিল। অ্যাবিলিটি আগের মত নেই, তাই চলে যাচ্ছে।’
অর্ধেক ক্রেতা হারানোর কথা বললেন শানুয়ারা ফ্যাশনের বিক্রেতা মো. ইমরানও। গত ঈদের মত বিক্রি হচ্ছে না এবার। মার্কেটে যে পরিমাণ ভিড় হচ্ছে সে পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে না। যারা কিনছে তারা ২টার জায়গায় একটা কিনছে।
মিরপুর ১১ নম্বরের মোহাম্মদীয়া মার্কেটের অন্য দোকানগুলোর তুলনায় শিশু চত্বরে বেশ ভিড় দেখা গেছে। তবে মক্কা মদিনা বাণিজ্যালয়ের ব্যবস্থাপক মো. রাশেদ বলছেন, ‘ভিড় হলেও বিক্রি তেমন হচ্ছে না; কারণ ক্রেতা একজন, তার সঙ্গে আরও চারজন দোকানে ভিড় করছেন।’
জান্নাত বোরকা হাউজে বিক্রি হচ্ছে শিশুদের পার্টি ফ্রক। দোকানটির ব্যবস্থাপক নাদিম হোসাইন বলেন, ‘বছরের প্রথম ঈদ অনুযায়ী বাজারে যে চাপটা থাকার কথা, সেই চাপ এবার তারা এখনও পাচ্ছেন না। তবে ঈদের ছুটি শুরু হলে বিক্রি বাড়তে পারে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি।’
নান্নু মার্কেটের ফ্যাশন ফেয়ারে বিক্রি হয় ছেলেদের টিশার্ট, প্যান্ট, শার্ট। দোকানটির বিক্রেতা রাতুল আজিজ খান বলেন, ‘পোশাকের দাম কিছুটা বাড়ায় এবার তারা অর্ধেকের মত ক্রেতা হারিয়েছেন। আগে পাঞ্জাবি কিনেও অন্যকিছু কিনত পরে পরার জন্য, এইবার পাঞ্জাবি কেনার পর আর কিছু কিনতে চাচ্ছে না। আমরা যে দামে কিনে আনছি সেটার কমে তো বিক্রি করতে পারি না। কাস্টমার আগের রেটই ধরে রাখছে, বেশি দামে নিতে চায় না। বসে আছি, এমন অবস্থা।’
মিরপুর ১০ নম্বরের ছেলের পোশাকের দোকান ইসরাতে বিক্রি হচ্ছে ছেলেদের শার্ট, প্যান্ট, টি শার্ট, পাঞ্জাবি। ক্রেতা টানতে দোকানটিতে বিভিন্ন পোশাকের উপর ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়েছে। এতে ক্রেতা কিছুটা বাড়লেও আশানুরূপ বিক্রি করতে না পারার কথা বলছেন দোকানটির বিক্রেতা মো. ইব্রাহিম।
তিনি বলেন, ‘ঈদের কেনাকাটার জন্য যে চাপ হয়, ওই রকম চাপ এখনো পড়েনি। মানুষ অর্থনৈতিক চাপে আছে, সবকিছুর দাম বেশি। তাদের দিকে তাকিয়েই ছাড় দেওয়া হয়েছে। আর দুই চারদিন গেলে দেখা যাবে, বাড়ে কিনা। অন্যান্য বছর আরও আগে থেকেই চাপ পরত মার্কেটে। মিরপুর ১০ নম্বরের শাহ আলী প্লাজা থেকে থ্রি পিস কিনেছেন সাদিয়া ইসলাম।’
তিনি বলেন, ‘তার দুটো থ্রি পিস কেনার পরিকল্পনা ছিল তবে দামে না মেলায় একটি কিনেই ফিরে যাচ্ছেন তিনি।আগের চেয়ে সাত/আটশত টাকা দাম বেড়েছে। এফোর্ট করা যাচ্ছে না। এ মাসে টিউশনি পেয়েছি, ভেবেছিলাম বাসার সবার জন্য কিছু কেনাকাটা করব কিন্তু যে দাম হচ্ছে না, তাই কারোর জন্য কিছু কিনিনি।’
তাসিন ফেব্রিক্সে বিক্রি হয় নারীদের থ্রি পিস ও গজ কাপড়। দোকানটির স্বত্বাধিকারী হুমায়ুন কবীর বলেন, রোজার শুরুর দিকে মোটামুটি বিক্রি হলে, দিন দিন তাদের বিক্রি কমে আসছে। আজ যা ভিড় দেখছেন তা ছুটির কারণে। কিন্তু এবার তিনভাগের একবার বিক্রি কমে গেছে, কম দামি জিনিসের দিকে কাস্টমারের চাহিদা বেশি, দামি জিনিস কিনতে চায় না। মানুষের আয় কমে গেছে।
এদিকে, ঈদ কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতির পালে হাওয়া বইছে। গত ১৯ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে পাওয়া সবশেষ তথ্য বলছে, ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের গতি বেড়েছে। চলতি (মার্চ) মাসের ১৯ দিনে প্রবাসীরা ২২৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে) যার পরিমাণ ২৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকার বেশি। এই ১৯ দিনের হিসাবে প্রতিদিন গড়ে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১২ কোটি ডলার বা এক হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এ ধারা অব্যাহত থাকলে মার্চে প্রবাসী আয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হতে পারে।
এটা দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য একটি ভালো লক্ষণ। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ ঈদের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে অনেকটা সহায়ক হবে। তবে ঈদকেন্দ্রিক অনেক ব্যয় এবার সংকোচন হবে বেশ কিছু কারণে। যার প্রভাব পড়তে পারে ঈদের টোটাল বাণিজ্যে।