ট্যাক্স ফাঁকি দিতে আমদানির চার্টে মূল্য কম দেখিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আমদানি মূল্য দেখলে মনে হবে আমরা শায়েস্তা খাঁর আমলে বসবাস করছি। কিন্তু কিনতে গেলে সেটি হাজারগুণ বেশি দাম দিতে হচ্ছে।
মজার বিষয় হলো! এত কম দরে কীভাবে পোশাক আমদানি হয়, তা আমারও মাথায় ঢোকে না। যদিও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ঠিকই নির্ধারিত মূল্যে শুল্কায়ন করে। মূলত ভারত ও পাকিস্তান এই দুই দেশ থেকে পোশাক আমদানিতে মূল্য কম দেখানো হয় বলে জানান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক কর্মকর্তা।
পাকিস্তান থেকে অনয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল গত ১৬ মার্চ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৬৫ টাকায় প্রতি পিস পাঞ্জাবি আমদানি করেছে। অবশ্য এই দর অবিশ্বাস্য কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছেই। এ জন্য ঢাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ ৬১০ টাকা মূল্য ধরে শুল্কায়ন করেছে। তাতে প্রতি পিসে ৬২২ টাকা শুল্ক-কর আদায় করেছে কাস্টমস।
জানা গেছে, আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি এক থেকে দুই ডলারে মেয়েদের থ্রি-পিস আমদানি করেছে প্রায় ৭০ হাজার পিস। এদিকে, উন্নত মানের ভারতীয় থ্রি-পিসের দাম মাত্র ৪৮ টাকা। সাধারণ মানের থ্রি-পিসের দাম আরও কম। মাত্র ৪০ টাকা। শুধু সালোয়ার-কামিজ হলে আরও কমে যায় দাম। মাত্র ১৮ টাকা। মেয়েদের ‘টপস’ মাত্র ১১ টাকা। শাড়ির দামও বেশি নয়। উন্নত মানের ভারতীয় শাড়ির দাম প্রতি পিস মাত্র ৬০ টাকা। মেয়েদের সবচেয়ে দামি পোশাক হলো লেহেঙ্গা। কত দাম জানেন? মাত্র ১০৫ টাকা। ‘গর্জিয়াস’ লেহেঙ্গার দাম একটু বেশি, সেটাও মাত্র ১২০ টাকা।
আবার ছেলেদের পোশাকের দামও এমনই। যেমন পাকিস্তানের পাঞ্জাবির দাম মাত্র ৬৫ টাকা। শিশুদের পাঞ্জাবির দর বড়দের অর্ধেক, প্রতি পিস ২৯ টাকা, অবশ্য তা ভারতীয় পাঞ্জাবি। এতক্ষণ যা বলা হলো তাতে বাজারদর কমেছে এমনটি ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আবার ক্রেতা হিসেবে উচ্ছ্বসিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এই দর আছে শুধু কাগজে-কলমে। ভারত-পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই দরে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পোশাক আমদানি করেছেন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যভান্ডারে আমদানির এমন চিত্র মিলেছে। কম মূল্য পোশাক আমদানি নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনের পর এই বিষয় আলোচনায় এসেছে। এসব পোশাক আনা হয়েছে ঈদের বাজারে বেচাকেনার জন্য।
তবে বাজারে এসব পোশাক কিনতে হলে অন্তত ৫০ থেকে ১০০ গুণের বেশি দাম গুণতে হবে ক্রেতাদের। যেমন চট্টগ্রামের আফমি প্লাজায় দেখা যায়, পাকিস্তানের সাধারণ থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকায়। উন্নত মানের থ্রি-পিসের দাম ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা। এর মানে হলো, বাজারে বিদেশি পোশাকের যে চড়া দাম, তার সঙ্গে আমদানি মূল্যের হিসাব মিলছে না। ট্যারিফ কমিশন ১০ মার্চ এক প্রতিবেদনে দেশি শিল্পকে সুরক্ষা এবং রাজস্ব বাড়াতে শুল্কমূল্য বিধিমালা অনুসারে অর্থাৎ পোশাকের যাতে প্রকৃত বিনিময়মূল্য প্রতিফলিত হয়, সেভাবে শুল্কায়ন করার জন্য সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে পোশাকের চালান যথাযথভাবে যাচাই করারও সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
এত কম দরে পোশাক আমদানির নজির তৈরি করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মেয়েদের পোশাক এনেছে ঢাকার ভাটারার ভিক্টোরিয়া ইন্টারন্যাশনাল, এলিফ্যান্ট রোডের এ আর ইন্টারন্যাশনাল ও পান্থপথের প্রতিষ্ঠান এভার গ্লোবাল। ছেলেদের পাকিস্তানের পাঞ্জাবির রেকর্ডটা নিজেদের করে রেখেছে ঢাকার খিলক্ষেতের অনয়া ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল। বাচ্চাদের পাঞ্জাবির রেকর্ডটা ঢাকার নিউমার্কেটের সাদিয়া এন্টারপ্রাইজের। এ রকম বহু আমদানিকারকের নাম আছে তালিকায়।
একই অবস্থা ভারত থেকে পোশাক আমদানিতেও। যেমন এলিফ্যান্ট রোডের এ আর ইন্টারন্যাশনাল গত ১৬ জানুয়ারি ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ৪০ টাকা দরে থ্রি-পিস আমদানি করেছে। পান্থপথের গ্রিনরোডের এভার গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান অবশ্য ৪৮ টাকায় ৩৩ পিস উন্নত মানের থ্রি-পিস আমদানি করেছে। কাস্টমস ৪৮ টাকার থ্রি-পিসের মূল্য ১ হাজার ৪৬৪ টাকা ধরে শুল্কায়ন করেছে।
একই প্রতিষ্ঠান ১০৫ টাকা দরে সাধারণ লেহেঙ্গা আমদানি করেছে ভারত থেকে। গর্জিয়াস লেহেঙ্গা আমদানি করেছে ১২০ টাকায়। অবশ্য ঢাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এই দুই ধরনের পোশাকের শুল্কায়ন করেছে যথাক্রমে ৩ হাজার ৫০ টাকা ও ৫ হাজার ৪০০ টাকা দরে।
শুধু থ্রি-পিসই নয়, এভার গ্লোবাল ৬০ টাকায় উন্নত ও মধ্যম মানের শাড়ি আমদানির রেকর্ড গড়েছে। গত জানুয়ারিতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে তারা এই দরে শাড়ি এনেছে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এই শাড়ি ১ হাজার ৮০০ টাকা দাম ধরে শুল্কায়ন করেছে। আবার বেনাপোল বাজারের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান রহমান অ্যান্ড ব্রাদার্স বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১ হাজার ৩০০ পিস টপস আমদানি করেছে। প্রতিটি টপসের দাম পড়েছে ১১ টাকার কম।
এনবিআরের তথ্যভান্ডারে দেখা যায়, ভারত-পাকিস্তান থেকে গত ডিসেম্বর থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত সাড়ে ৩২ লাখ পিস পোশাক আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে ১০০ টাকার কমে পোশাক আমদানি হয়েছে সোয়া ৮ লাখ পিস। অন্তত সোয়া ১০ লাখ পিস পোশাক আমদানি হয়েছে যেগুলোর আমদানির মূল্য দেখানো হয়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া ৬ লাখ ৮৩ হাজার পোশাক আমদানি হয়েছে, যেগুলোর প্রতি পিসের দাম ২০১ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। অর্থাৎ বিশ্বাসযোগ্য দামে পোশাক আমদানির পরিমাণ হাতে গোনা।
পোশাকের মূল্যের এত কম দরের নেপথ্যের কারণ আমদানিতে উচ্চশুল্ক। এই শুল্ক ফাঁকি দিতে পোশাকের দরের এমন তথ্যের স্বপক্ষে রপ্তানিকারকের ‘সনদ’ বা ইনভয়েসও রয়েছে আমদানি কারকদের। আমদানি-রপ্তানিকারক, এই দুই পক্ষের এমন বোঝাপড়ার সনদ সবাই বিশ্বাস করলেও কাস্টমস কর্মকর্তারা করেননি। আমদানিকারকদের ফাঁকির বিষয়টি তাঁরা অবগত। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১২ গুণ বেশি দাম ধরে শুল্কায়ন করছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, ছয়টি শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান থেকে তৈরি পোশাক আমদানি হচ্ছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশই আসছে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। এই বিমানবন্দর দিয়ে আনা পণ্য শুল্কায়ন করে ঢাকা কাস্টমস।
জানতে চাইলে ঢাকা কাস্টমসের কমিশনার মুহম্মদ জাকির হোসেন বলেন, শুল্ক মূল্যায়ন বিধিমালা অনুসারে পোশাকের চালান শুল্কায়ন হচ্ছে। এরপরও আমরা ধীরে ধীরে প্রকৃত মূল্যে শুল্কায়নের প্রক্রিয়ায় আছি।
ভারত ও পাকিস্তানি তৈরি পোশাক যে দামে শুল্কায়ন হচ্ছে, তা অবিশ্বাস্য বললেন ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এফইএবি) সভাপতি আজহারুল হক আজাদ।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আন্ডার ইনভয়েসের (কম মূল্য ঘোষণা) ঘটনা ঘটছে। এ জন্যই ভারত-পাকিস্তান থেকে এত পোশাক আসতে পারে।
তিনি আরও বলেন, আমরা দেশি পোশাকের ব্যবসায়ীরা দুটি কারণে অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে আছি। বৈধপথে বিদেশি পোশাক আমদানিতে আন্ডার ইনভয়েসের ঘটনা ঘটছে। অবৈধপথে পোশাক আসার সীমা-পরিসীমা নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে চাই, বাইরের পণ্য আসার বিষয়টি তদারকি হওয়া দরকার। ভোক্তা অধিকারকে আমদানি পোশাকের বিষয়ে তদারকি করতে হবে। পণ্যের দামের সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যভাবে মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া দরকার। অন্যথায় দেশি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়বেন।