জ্বালানি নির্ভরযোগ্য গ্যাস: সেবার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনা

একেই বলে হিতে বিপরীত। তাইতো সেবার ক্ষেত্রে বিড়ম্বনার শেষ নেই। কথা ছিল গ্যাসের সেবা বাড়ানো একইসঙ্গে জটিলতা থেকে নিস্কৃতির। কিন্তু কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ সেবার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে! 

দেশের অর্থনীতির গতিসঞ্চার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে গেলে জ্বালানির নিশ্চয়তা পরিহার্য্য। বর্তমান সময়ে জ্বালানির নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হচ্ছে গ্যাস। এক্ষেত্রে গ্যাসের নিরববিছন্ন সরবরাহের নিশ্চিত করণের চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নই একমাত্র বিকল্প। বিগত সরকার গ্যাসের দেশিয় উৎপাদনের দিকে না যেয়ে আমদানি নির্ভরতা গড়ে তোলে। যা আমদানি কারকদেরকে আর্থিক সফলতার নিশ্চয়তা দেয়। কিন্তু দেশে গ্যাস সংকট মোকাবিলা বা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে সেই শূন্যতা পূরণে কোন কাজে আসেনি। 

বলতে হয়, আমাদের দেশের সব ধরনের উৎপাদন জ্বালানি সঙ্কটও পড়ে ব্যাহত হয়েছে। এসময় গ্যাসের নতুন সংযোগ, লোডবৃদ্ধি, কারখানার যন্ত্রাংশের পুনর্বিন্যাসে শিল্পমালিকদের ভোগান্তি কেবল বেড়েছে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য গ্যাসের নিরিবিছিন্ন সরবরাহের নিশ্চয়তা  চাওয়া হয়। গ্যাসের এই সরবরাহ দেশিয় উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করবে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি-বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে এসঙ্কট থেকেই গেছে। বরং ক্ষেত্র বিশেষে জটিলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

কথা হয় বেশ কয়েকজন শিল্প মালিকের সঙ্গে তারা নিজেদের নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে নিজেদের ক্ষোভ এভাবেই প্রকাশ করেন। শিল্পকারখানায় গ্যাসের লোড বৃদ্ধি, নতুন সংযোগসহ নানা জটিলতার সমাধান এসব সমস্যা গ্যাস কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদই দিতেন। এসময় তদবিরের মাধ্যমে কোনো না কোনো উপায়ে দ্রুত কাজ আদায় করিয়ে নেওয়া যেত। 

কিন্তু এখন সেগুলো প্রায় বন্ধই রয়েছে। বর্তমানে বকেয়াসহ কোনো কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে নতুন করে সংযোগ পেতে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে হচ্ছে। অনেক সময় এত দীর্ঘ সময় লাগছে  যে, অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। 

শিল্পখাতের একাধিক ব্যবসায়ী বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে এমনও ঘটনাও ঘটছে, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর অনুমান নির্ভরতা এসব ক্ষেত্রে চরম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। 

কোম্পানি যে ভুল করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে, সেটা প্রমাণ করতেই বছর লেগে যাচ্ছে। তাদের হাতে এতটাই ক্ষমতাশালী যে বাঘে ছুলে আঠারো ঘা’র প্রবাদকে হার মানিয়ে দিচ্ছে। সেই দীর্ঘসূত্রিতার কারণে সংযোগ বিছিন্নের কবলে পড়ে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হচ্ছে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। 

ক্ষুব্ধ মালিকরা বলছেন, শিল্পকারখানার গ্যাস সংযোগ প্রদান তথা গ্যাস-সেবার বিষয়ে ওয়ান স্টপ সার্ভিস করার কথা থাকলেও সেপথে কর্তৃপক্ষ হাঁটছেন না। 

অভিযোগের বিষয়ে তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, এখন কোম্পানির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অন্য একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে। অথচ কোম্পানির যাবতীয় দায়বদ্ধতা জ্বালানি বিভাগের সচিবের কাছে। ফলে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়েছে। 

ভোগান্তির নমুনা: খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘ জটিলতায় আটকা পড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অনেক চালু শিল্পকারখানা। সাম্প্রতিক সময়ে নারায়ণগঞ্জের বরিন টেক্স নামে একটি কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ১০ কোটি টাকা জরিমানা পরিশোধ করার পরও কারখানাটির সংযোগ পেতে সময় লেগেছে প্রায় দুই মাস। গাজীপুরের এমএসসি নিট নামে একটি কারখানার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। ৮ কোটি টাকা জরিমানা পরিশোধ করেও সংযোগ পেতে সময় লেগেছে দুই মাস। এ সময় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ক্রেতাদের অনেকেই অর্ডার ক্যানসেল করে দিয়েছেন।

সর্বশেষ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের গত ২১ এপ্রিল ইস্যু করা এক চিঠিতে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে পূর্বানুমতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ১৬ এপ্রিল সভার রেফারেন্স দিয়ে লেখা চিঠিতে শিল্প ও ক্যাপটিভ শ্রেণিতে নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এসব নির্দেশনায় জরুরি প্রয়োজনে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে কেস টু কেস ভিত্তিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে গ্যাস সংযোগ প্রদান করা যেতে পারে। 

বিষয়টি সব গ্যাস বিপণন ও বিতরণ কোম্পানিকে অবহিত করার জন্য পেট্রোবাংলা নির্দেশ দেওয়া হয়। এর আগে গত ১৬ এপ্রিল উপসচিব রুবায়েত খান ৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে একটি চিঠি ইস্যু করেন। 

এতে বলা হয়, গ্যাস সংযোগ প্রদানের আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে আবেদনগুলো নতুন সংযোগ, লোড বৃদ্ধি এবং প্রতিশ্রুত- এই তিন ভাগে বিভক্ত করতে হবে। এরপর গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো কর্তৃক গ্যাসের পর্যাপ্ততা বিবেচনায় নিয়ে একটি অগ্রাধিকার তালিকা  প্রস্তুত করে জ্বালানি বিভাগ ও  পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করবেন। নতুন সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহকের গ্যাস প্রাপ্তি নিশ্চিত কররা ছাড়াও অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হবে রাজস্ব বৃদ্ধি করা। 

সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলছেন, তাহলে বিতরণ কোম্পানিগুলোর যে বিশাল জনবল এবং জোনভিত্তিক অফিস, তারা কী করবেন? তারা কী কেবল মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করবেন?  হাজার হাজার শিল্পকারখানার প্রতিদিনের শত শত ইস্যুর সমাধান কীভাবে হবে? এ ছাড়া কোম্পানির বোর্ডই বা কী করবে? 

এদিকে শুধু মন্ত্রণালয় বা তিতাসের বোর্ড নয়, জটিলতা রয়েছে আরও অনেক। শিল্প মালিকদের লাইসেন্সসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনেও (বিইআরসি) দৌড়াতে হয়। 

সঙ্গতকারণেই ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে দিন দিন ব্যবসার পরিবেশ জটিল হয়ে উঠছে। জ্বালানি বিভাগ থেকে প্রথম দফায় ইস্যু করা চিঠির পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে, নতুন সংযোগ অথবা লোড বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে যে অতিরিক্ত গ্যাস বরাদ্দ প্রয়োজন হবে, তা নিরূপণ করে যথাসময়ে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। 

গ্যাসের ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। পরিস্থিতিতেই দেশে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। ফলে নতুন সংযোগের সঙ্গে এখনই এলএনজি আমদানির ইস্যু সম্পৃক্ত নয়। এ ছাড়া চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানির সক্ষমতা এ মুহূর্তে দেশের নেই। এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি এলএনজি আমদানি করতে হলে অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে নতুন করে। দেশে শিল্পকারখানা চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস পায় না। অর্ধেকের বেশি এখনও ঘাটতি রয়েছে। প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ করতে হলে দৈনিক আরও ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা দরকার। 

যদিও পেট্রোবাংলার ভাষ্য, গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের মতো। তাদের হিসাব যথার্থ ধরা হলেও প্রতিদিন ঘাটতি থেকে যায় প্রায় ১৩’শ মিলিয়ন ঘনফুট। পূর্ণসক্ষমতায় এলএনজি আমদানি করলে সরবরাহ বাড়বে মাত্র ৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো।

এসব বিষয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমান ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে বলেছেন, কারও ক্ষমতা খর্ব করার জন্য নয়, মনিটরিং বাড়ানোর জন্যই নানা কমিটি করা হয়েছে। 

বিতরণ কোম্পানিগুলোর সূত্র জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্যাসের সংযোগ, লোড বৃদ্ধি, বকেয়ার জন্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে দ্রুত সংযোগ দেওয়ার তদবির বেড়েছে। ফলে অনেক কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজেও চান যেন তাদের ওপর তেমন কোনো দায়িত্ব না থাকে। 

এ বিষয়ে কথা হয় ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলমের সঙ্গে। তিনি যেমনটি বলছিলেন। নির্বাহী আদেশে এই কাজগুলো করা সমীচীন হচ্ছে না। কর্তৃত্বগুলো স্বচ্ছ এবং আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার। কোম্পানিগুলো বোর্ড সংশ্লিষ্ট ও দক্ষ লোক দিয়ে গঠনের প্রয়োজন রয়েছে।