গার্মেন্ট থেকে প্রথম ১১ মাসে রপ্তানি আয় ৩৬.৫৬ বিলিয়ন ডলার 

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই ২০২৪ থেকে মে ২০২৫) বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে— বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক  খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে দৃঢ়ভাবে। বিশ্বের প্রধান বাজারগুলোতে চাহিদা বৃদ্ধি, কৌশলগত বাজার বৈচিত্র্য এবং মাননির্ভর উৎপাদনের কারণে এ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন শীর্ষে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবৃদ্ধি সর্বাধিক
রপ্তানির গন্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এখনও বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা অঞ্চল। ১১ মাসে ইইউ-ভুক্ত দেশগুলোতে রপ্তানি হয়েছে ১৮ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার, যা মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ৪৯ দশমিক ৯১ শতাংশ।

এ সময়ের মধ্যে ইইউতে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ইইউয়ের মধ্যে জার্মানিতে সর্বাধিক রপ্তানি হয়েছে— ৪ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার, এরপর রয়েছে স্পেন ৩.১৬ বিলিয়ন এবং ফ্রান্সে রপ্তানি হয়েছে ২ বিলিয়ন ডলার।

অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বেড়েছে ১৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা মোট ৭ দশমিক ০৩ বিলিয়ন ডলার। এই প্রবৃদ্ধিকে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির বাজারে স্বল্পদামি পোশাকের চাহিদা, ভিয়েতনাম ও চীনের বাজারের কিছুটা সংকোচন এবং বাংলাদেশের সরবরাহ সক্ষমতার ফল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

যুক্তরাজ্য ও কানাডাও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে অবস্থান করছে। যুক্তরাজ্যে ১১ মাসে ৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তবে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কম— মাত্র ৩.৯৬ শতাংশ। কানাডায় রপ্তানি হয়েছে ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৪.১৪ শতাংশ।

অপ্রচলিত বাজারেও চাঙাভাব
বাংলাদেশের রপ্তানির বিস্তার এখন আর কেবল ঐতিহ্যবাহী বাজারে সীমাবদ্ধ নেই। অপ্রচলিত বা নন-ট্র্যাডিশনাল বাজারেও তৈরি পোশাক রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।

এ সময় এসব বাজারে রপ্তানি হয়েছে ৬ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা মোট পোশাক রপ্তানির ১৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির হার ৬.৭৯ শতাংশ।

বিশেষ করে ভারত, তুরস্ক ও জাপানে প্রবৃদ্ধি ছিল চোখে পড়ার মতো—ভারতে রপ্তানি বেড়েছে ১৭.৩৫ শতাংশ, তুরস্কে ৩১.৭৫ শতাংশ এবং জাপানে ১০.৩২ শতাংশ।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১২ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে শীর্ষ ১০টি গন্তব্য দেশেই। এর মধ্যে ছয়টি বাজারে প্রবৃদ্ধির হার দুই অঙ্কে। শীর্ষ গন্তব্যগুলো হলো— যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, ইতালি, কানাডা ও জাপান।

এই ১০ দেশে মোট রপ্তানি হয়েছে ২৮১০ কোটি ডলারের পোশাক, যা মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ৭৭ শতাংশ। আর সব মিলিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৩৬৫৬ কোটি ডলারে, প্রবৃদ্ধি ১০.২০ শতাংশ।

তবে কিছু বাজারে পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মালয়েশিয়ায় রপ্তানি হ্রাস পেয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা এর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

নিটওয়্যার-ওভেন খাতে প্রবৃদ্ধি
তৈরি পোশাক খাতের মধ্যে নিটওয়্যার পণ্যে (যেমন- টি শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার ইত্যাদি) রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ, যা এই খাতের সম্ভাবনাকে আরও দৃঢ় করেছে।

একইসঙ্গে ওভেন পোশাক (যেমন- শার্ট, প্যান্ট, ব্লেজার ইত্যাদি) রপ্তানি বেড়েছে ৯ দশমিক ৩০ শতাংশ। মানসম্পন্ন ফেব্রিক, ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে মিল রেখে ডিজাইন এবং সময়মতো সরবরাহে সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুই ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।

ইপিবির এই পরিসংখ্যান ও প্রবণতা প্রমাণ করে— বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এখনও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় একটি দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। তবে টেকসই প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে হলে বৈচিত্র্য, উদ্ভাবন, জবাবদিহি ও উৎপাদন দক্ষতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে—এতে কোনও সন্দেহ নেই।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
বিশ্ববাজারে প্রবৃদ্ধির এ ধারা বজায় রাখা সহজ হবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা, লোহিত সাগর ঘিরে জাহাজ চলাচলে ঝুঁকি, শিপিং খরচ বৃদ্ধি এবং কাঁচামালের সরবরাহ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটতে পারে যেকোনও সময়।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের পাল্টা শুল্ক স্থগিতাদেশ জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে শেষ হচ্ছে। এ ছাড়া দেশের গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, ব্যাংকিং অস্থিরতা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিও চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে।

এ প্রসঙ্গে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখনও প্রতিযোগিতায় আছে। তবে বিশ্ববাজারের পরিবর্তনশীল চাহিদা, পরিবেশগত মানদণ্ড এবং বৈচিত্র্যময় বাজারে প্রবেশ করাই হবে টিকে থাকার প্রধান শর্ত।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন, দক্ষ শ্রমশক্তি এবং আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে যেতে হবে।’