‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে/নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো। আমি শুনেছি সেদিন তুমি নোনাবালি তীর ধরে/বহুদুর বহুদুর হেঁটে এসেছো। আমি কখনও যাইনি জলে কখনও ভাসিনি নীলে/ কখনও রাখিনি চোখ, ডানা মেলা গাঙচিলে। আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে আমাকেও সাথে নিও/নেবে তো আমায়? বল নেবে তো আমায়? কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যেয়ে মৌসুমি ভৌমিকের এই গানকে খুঁজতে গেলে হতাশ হতেই হবে। এখানে মাদক, অনিয়ম, অসমাজিকতা ভর করায় হুমকির মুখে পড়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় সমুদ্র সৈকতটি।
দেশের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার এখন অনেকটাই অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। এখানে নানা ধরনের দুর্নীতি অনিয়ম যেমন বাসা বেধেছে পাশাপাশি বেড়েছে মাদকের কারবার।
এলাকায় আবাসিক প্রায় দুই শতাধিক হোটেল, ৪টি মোটেল, শতাধিক রেষ্টুরেন্টে চলছে অসামাজিক কার্যক্রম। অভিনত কায়দায় মায়ানমার সীমান্ত পথে এসব আবাসিক এলাকায় ঢুকছে ইয়াবা। পিয়াজের কোষ ফেলে মোড়কের ভেতরে ঢুকিয়ে নতুন এই কৌশলে মাদক আনা নেওয়া চলে।
এছাড়া নারিকেলের ভেতরে পানি ফেলে, মাছের পেটের নাড়িভুড়ি ফেলেও ইয়াবার কারবার চলছে। অপরদিকে পাহাড় কেটে প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঝুকিতে ফেলে তৈরি হচ্ছে নানান ধরনের স্থাপনা। ফলে, পুরো এলাকাটিই এখন পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এখানেই থেমে নেই দুর্বৃত্তরা। তারা সরকারি ভুমি দখল করে কক্সবাজারের সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করছে। এসব কারণে হুমকির মুখে এখন সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার। গত ১৮ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিস্টদের কথা বলে এ সব তথ্য পাওয়া গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, হোটেল মোটেল জোনেই অবাধে চলছে মাদক ব্যবসা। প্রতিদিনই এমনকি প্রায় সময়েই কোন না কোন হোটেলে ইয়াবাসহ বিভিন্ন চোরাই মালামালের প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে লেনদেন চলে। এখান কার মাদক সিন্ডিকেট এতোটাই শক্তিশালী যে, তারা প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা করলেও প্রশাসন তাদের টিকিটিও ছুতে পারে না।
কেন এমন হচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে নাম না প্রকাশের শর্তে একজন জানালেন তাদের সঙ্গে প্রশাসনের চুক্তি রয়েছে। এর আগে প্রশাসরে পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের গোপন চুক্তি ছিল। ৩৬ জুলাই বিপ্লবের পর তাদের পরিচয় বদলেছে। গড়ে উঠেছে নতুন নতুন সিন্ডিকেট। তিনি আর জানান, কেবল মাদক নয় এখনে নারীদের নিয়ে দেহ ব্যবসা চলে। যা প্রশাসন জানলেও সে নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। উর্ধতন কোন ব্যক্তি এলে তাদের কৌশলে ম্যানেজ করতে এই নারীদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শহর-শহরতলীর হোটেলমোটেল জোনে এ কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে একটি শাক্তিশালী সিন্ডিকেট ।
জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, গত তিন মাসে জেলা পুলিশ কক্সবাজার এলাকার বেশ কয়েকটি হোটেলে অভিযান চালিয়ে ১৩ কোটি ৩৫ হাজার ৭৫০ টাকা মূল্যেরমাদক উদ্ধার করেছে। এ সংক্রান্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িত ৪২৯ জনকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ১৫৮জনকে সাজা দেয়া হয়েছে।
অপরদিকে পাহাড় কেটে যততত্র হোটেল মোটেল নির্মাণ করায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সমুদ্র সৈতক এলাকার পরিবেশ সহ সৌন্দর্য রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন সম্মিলিত প্রতিরোধ। আর তা করা সম্ভব না হলে কক্সবাজার মুলত একটি ডাস্টবিনে পরিনত হবে।
এদিকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আরেক সংকট আর্বতে ঘুরপাক খাচ্ছে কক্সবাজার। এরা এলাকার স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে দিন দিন হয়ে উঠছে অনেকটাই বিরক্তিকর। এদের জীবনযাপন সহ চলাফেরা সমুদ্র সৈকতের স্বাভাবিক পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে।ইতোমধ্যে আপত্তিকর অসামাজিক কর্মকান্ডের মদদদাতা হিসেবে রোহিঙ্গারা বেশ পরিচিতি পেয়েছে বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সমুদ্র সৈকত এর পুরো এলাকায় একশ্রেনীর মানুষেরা নিজেদের প্রভাব বলয়ে নিয়ন্ত্রন করছে। এরা সমুদ্রের চর দখল করে হোটেল, মোটেল, রেষ্টুরেন্টসহ একাধিক ভবন নির্মাণ করছে। আইয়ুব আহমেদ দুলাল নামের স্থাণীয কলাতলি বাসিন্দা বলেন, যে যেভাবে পারছে টাকা ঢালছে, আর স্থাপনা তুলছে। এবং ভবনগুলোও হচ্ছে অত্যাধুনিক ডিজাইনের। কোনোটার চুঁড়ায় হ্যালিপ্যাডও রয়েছে। এমনিভাবে চলতে থাকলে সমুদ্র সৈকতএকদিন যানজটের শহর কিংবা ঘিঞ্জি বস্তির সৈকতে পরিনত হবে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ কামরুল আহসান খান বলেন, হোটেল বর্জ্যে সৈকতের জল এক দিন হয়তো ঢাকার বুড়িগঙ্গার মতো হয়ে যাবে। পানি স্পর্শ করার মতো অবস্থাও থাকবে না।
কক্সবাজার লাবনী বীচের এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মী প্রদীপ দেবনাথ জানান, যেভাবে পাহাড় কেটে ভবন নির্মিত হচ্ছে তাতে অচিরেই কক্সবাজার তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাবে। তিনি নচিকেতার সেই গানের কথা, ‘ভীড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় বিকেলের সোনা রোদ’ সেই ভাবেই এখানকার পরিবেশকে চুরি হচ্ছে।
তিনি বলেন এ পরিণতি খুবই ভয়াবহ হতে পারে। তারপরেও পরিবেশ বিজ্ঞানীদের এবিষয়ে কোন উদ্যোগ নেই। তিনি আশপাশের কয়েকটা জায়গা দেখিয়ে দিয়ে বলেন, তিন বছর আগে এই জায়গার দাম ছিল তিন থেকে দশ লাখ টাকা। বর্তমানে সেই জমি বিশ কোটি টাকা। টাকার দিকে কেউ তাকায় না। কার আগে কে নেবে, সেটাই মুলটার্গেট।
এদিকে রোহিঙ্গাদের নিয়ে সমস্যার কথা উল্লেখ করে সংশিষ্ট একটি সূত্র জানায়,বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিলেও তেমন কোন ফল আসছে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বাড়ছে।
জানা গেছে, পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্টান হওয়ায় আইনশৃংখলা বাহিনীর নজরদারী কম থাকার সুবিধা পেয়েছেন ওই অপরাধী চক্র। প্রতিদিন একের পর এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে সম্প্রতি পুলিশ অভিযান চালিয়ে মোটেল প্রবালের একটি কক্ষ তল্লাশি চালিয়ে ১৬৬৫ ইয়াবা উদ্ধার করে। তবে অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে ওই ইয়াবা ব্যবসায়ী পালিয়ে যায়। সরকারী বেতনের কর্মচারী হয়ে মোটা টাকার লোভে ইয়াবা গডফাদারদেরকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতাসহ অপরাধী চক্রের ভুয়া নাম ঠিকানা লিখে রেখেছেন রেজিষ্ট্রারে। এইসব বিষয় গোয়েন্দা প্রশাসনের তথ্যের ভিত্তিতে উৎঘাটন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কক্সবাজার শহরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হোটেলের মধ্যে হোটেল শৈবাল, হোটেল প্রবাল হোটেল উপাল, হোটেল লাবনীসহ ব্যক্তি মালিকানাধীন সৈকত পাড়া এলাকার সাউথ বীচ রিসোর্ট, হোটেল লাইট হাউজ এলাকার আলমগেষ্ট হাউজ, বেভিউ, থ্রী-স্টার রিসোর্ট, গ্রাউন্ড বীচ রিসোর্ট, হোটেল আলফা, ইকরা বীচ, সমুদ্র বিলাস, ক্যানিমা রিসোর্ট, এন এম কর্টেজ, প্রাইমর্পাক,বীচ ভিউ, ফাহিম কর্টেজ, সী ওয়েলকাম, হোটেল শামস,শাহ আমানত কটেজ, সী-পাল, আইল্যাডিয়া, সী-কিং, সী-কক্স, প্রতীক জিনিয়া,লাইট হাউজেরফয়সাল কটেজ, এসএম কটেজ, মামস কটেজ, সী-শার্ক রিসোর্ট,সবুজ ছায়ারিসোর্ট, রমজান কটেজ, শহরের জিয়া কমপ্লেক্স, সাতকানিয়া হোটেল, নজরুলবোডিং, আহসান বোডিং, থানার পিছন রোডের যমুনা গেষ্ট হাউজে অসামাজিক কার্ডক্রম চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
হোটেল মোটেল জোনের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, হোটেল মোটেল ও কটেজে টেকনাফ, উখিয়া ও শহরের আলোচিত ইয়াবা ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন ধরেই হোটেলমোটেল জোনকে নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ওই হোটেলগুলোতে নিয়মিত ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক দ্রব্যের লেনদেন হয়। হোটেলগুলোর কক্ষেবসে প্রতিদিন লেনদেন ও ভাগবাটোয়ারা হয়ে থাকে লাখ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট ও কোটি কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের চোখে ফাঁকি দিয়ে হোটেল কক্ষ হতে বিমান যোগে ঢাকায় পৌঁছে যাচ্ছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের বড় বড় চালান। ওই হোটেল গুলোতে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়মিত অবৈধ সহবাস করে আসছে এক শ্রেণীর পতিতা সিন্ডিকেট। পতিতা সিন্ডিকেটটি দীর্ঘদিন ধরেই হোটেলমোটেল জোনের কর্মচারীদের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে পতিতা ব্যবসা চালিয়েআসছে। প্রতিটি হোটেল-মোটেলের পাশেই রয়েছে রেঁস্তোরা তাই পতিতাদেও নিয়ে ইয়াবা গডফাদাররা আনন্দ-বিনোদনে ভারী করে করতে পারে।
এ অভিযোগের বিষয়ে মোটেল প্রবালের ব্যবস্থাপক খুরশেদ আলম বলেন, আমিযোগদান করার পর থেকে এখানে তেমন কিছু হয়নি। যা হয়েছে তা আগে হয়েছে। এছাড়া এটি পর্যটন মোটেল হিসেবে অনেক কিছুই আমরা এড়িয়ে চলি।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন জানিয়েছেন, কক্সবাজার দেশের বৃহত্তম একটি পর্যটন রাজধানী। প্রকৃতির দেওয়া বিশাল এই সমুদ্র সৈকতে নিয়মিত দেশ-বিদেশ হতে বিভিন্ন শ্রেণীর পর্যটক আসছে। কিন্ত হোটেল মোটেল জোনের অনিয়ম অবৈধ কাজে সহযোগিতা করার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে সত্যতা খুঁজে।