সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ একটি জেলা কুষ্টিয়া জেলা। বাউল সম্রাট লালনের, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতি বিজড়িত স্থান। চাইলে কুষ্টিয়ার এসব ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান দুই দিনেই ঘুরে দেখতে পারবেন।
লালন সাঁইজির মাজার
কুষ্টিয়া জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান হলো লালন আখড়া বা লালন সাঁইজির মাজার। এটি কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালি উপজেলায় অবস্থিত। এটি মূলত লালনের কবর স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা। বছরে দুই সময়ে এ জায়গায় লালন মেলা বসে। কুষ্টিয়ার মজমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে মাত্র ২০ মিনিটে লালন আখড়ায় যেতে পারেন। অটোরিকশায় জনপ্রতি ২০ টাকা করে ভাড়া।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি বাংলাদেশের অন্যতম এক দর্শনীয় স্থান। এটি কুষ্টিয়া থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে কুমারখালী উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নে অবস্থিত। কুষ্টিয়ার চৌড়হাস থেকে জনপ্রতি ৫০ টাকা অটো রিকশায় যাওয়া যায়। বাগান, পুকুর ও কুঠিবাড়ির মূল ভবনসহ এর আয়তন ৩৩ বিঘা। আর মূল ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে আড়াই বিঘার ওপর। ছোট-বড় সব মিলিয়ে এতে মোট কক্ষ রয়েছে ১৮টি।
অত্যন্ত মনোরম ভাবে সাজানো এই কুঠিবাড়ি। জমিদারি দেখাশোনা করতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে প্রায় এক দশক অনিয়মিতভাবে এখানে অবস্থান করেছেন। এখানে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার্য অনেক জিনিসপত্রই রয়েছে।
মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা
বিষাদ সিন্ধুর রচয়িতা বিখ্যাত উপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেনের বাড়ি কুষ্টিয়ার সৈয়দ মাসুদ রুমি সেতুর টোল ঘাটের পাশে লাহিনীপাড়া মোড় নামক স্থানে অবস্থিত। কুষ্টিয়া শহর থেকে জনপ্রতি ৩০ টাকা অটোরিকশা ভাড়ায় সেখানে যাওয়া যায়। তার এ জন্মস্থানকে ঘিরে বর্তমানে এখানে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, একটি লাইব্রেরি, জাদুঘর ও অডিটোরিয়াম রয়েছে। সেখানে মীর মশাররফ হোসেনের ব্যবহার্য জিনিসপত্র রয়েছে।
জুগিয়া তাঁতীপাড়া
কুষ্টিয়ার জুগিয়া গ্রামে অবস্থিত এই তাঁতীপাড়া স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে আকর্ষণীয়। কুষ্টিয়া শহর থেকে রিকশাযোগে এক ঘণ্টায় তাঁতীপাড়ায় পৌঁছানো সম্ভব। তাঁতীপাড়ায় ভ্রমণ করলে তাঁতীদের জীবন সম্পর্কে জানা যাবে এবং বাংলাদেশের লোকজ তাঁত শিল্প সম্পর্কে জানা যাবে।
টেগর লজ ও মোহিনী মিল
কুষ্টিয়ার মিলপাড়ায় অবস্থিত রবীন্দ্র সদন বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানেও মাঝেমধ্যে অবস্থান করতেন। শিলাইদহ থেকে ১০ মিনিটের পথ এটি। কুষ্টিয়া শহরের অন্যতম আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক স্থাপনা এটি। বর্তমানে এটি মিউজিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইতিহাস ও সাহিত্যপ্রেমী এবং সংস্কৃতিবান মানুষ এখানে বেশি ভ্রমণ করেন। এর পেছনে রয়েছে অবিভক্ত বাংলার প্রথম ও প্রধান বস্ত্রকল ‘মোহিনী মিলস’। এক যুগের বেশি সময় ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে মিলটি। কথিত আছে, একসময় মোহিনী মিলের হুইসেলের শব্দ শুনে এলাকাবাসী তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম শুরু করত।
গড়াই নদী
কুষ্টিয়া শহর প্রধানত গড়াই নদীর অববাহিকায় অবস্থিত। স্থানীয়রা একে মধুমতি নামে চেনেন। সূর্যাস্তের সময়ে দর্শনার্থীরা এখানে ভ্রমণ করেন। বিশেষ করে গরমের সময়ে এখানে সব বয়সের দর্শনার্থীদের আসতে দেখা যায়। মনোমুগ্ধকর ও ভুবনমোহিনী প্রাকৃতিক দৃশ্য চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের জন্য উত্তম। পাশাপাশি গড়াই নদীর উপর হরিপুর ব্রিজ নির্মাণ হয়েছে। যা আরো দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে।
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার স্মৃতি জাদুঘর
হরিনাথ মজুমদার যিনি কাঙাল হরিনাথ নামে সমধিক পরিচিত। তিনি বাউল সংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তিনি ফকির চাঁদ বাউল নামেও পরিচিত ছিলেন। কাঙাল হরিনাথ মজুমদার এ উপমহাদেশের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ প্রকাশ করেন। প্রথম দিকে তিনি হাতে লিখে পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। পরে কলকাতা থেকে একটি পুরোনো মুদ্রণযন্ত্র (প্রেস) এনে সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন।
কবি আজিজুর রহমান
‘আকাশের ঐ মিটি মিটি তারার সাথে কইব কথা’, ‘নাই বা তুমি এলে’, ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের জাদু এনেছি’সহ অসংখ্য কালজয়ী গানের রচয়িতা এবং গীতিকার কবি আজিজুর রহমানের জন্ম কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর গ্রামে। একুশে পদকপ্রাপ্ত এই কবি ও গীতিকার দুই হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। কুষ্টিয়া শহর থেকে মাত্র ২০-৩০ টাকা ভাড়ায় হাটশ হরিপুর ইউনিয়নে কবির ভিটায় যাওয়া যায়।
গগন হরকরা
গগন চন্দ্র দাস বাংলা লোকসংগীত শিল্পী ও সংগীত রচয়িতা। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সংগ্রহ করেছিলেন গগন হরকরা রচিত একটি গানের সুর থেকে। গগন হরকরা ছিলেন বিশিষ্ট বাউল গীতিকার। জন্ম বাংলাদেশের শিলাইদহের নিকটস্থ আড়পাড়া গ্রামে। শিলাইদহ ডাকঘরে চিঠি বিলি করতেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গুণমুগ্ধ ছিলেন।
রাধা বিনোদ পাল
জন্ম ১৮৮৬ সালের ২৭ জানুয়ারি। মৃত্যু ১৯৬৭ সালের ১০ জানুয়ারি। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি যুদ্ধাপরাধীর প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দূরপ্রাচ্যের ট্রায়ালের আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের বিচারক ছিলেন তিনি। জাপানিদের ইতিহাসে রাধা বিনোদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
১৮৮৬ সালের ২৭ জানুয়ারি দৌলতপুর উপজেলার মধুরাপুর ইউনিয়নের তারাগুনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। এরপর মিরপুর উপজেলার সদরপুর ইউনিয়নের কাকিলাদহ গ্রামের বসতি স্থাপন করেন।
রেনউইক বাঁধ
শহরের গড়াই নদী সংলগ্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আখ মাড়াই কলের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা ছিল রেনউইক অ্যান্ড যজ্ঞেশ্বর কোম্পানি। ছায়াঘেরা সুন্দর পরিবেশের এ কোম্পানির শেষ প্রান্তে নদীর তীরে গড়ে তোলা হয়েছে শহররক্ষা ‘রেনউইক বাঁধ’। শত শত মানুষ এখানে বেড়াতে আসে। চাইলে নৌভ্রমণ করতে পারেন পর্যটকরা।
ইউটিউব ভিলেজ
সোশ্যাল মিডিয়া ইউটিউবের কল্যাণে শিমুলিয়া গ্রামের নাম বদলে হয়ে গেছে ‘ইউটিউব ভিলেজ’। গ্রামটির আসল নাম শিমুলিয়া হলেও ২০১৬ সালের পর এটি পরিচিত হচ্ছে ইউটিউব ভিলেজ নামে। ইউটিউব চ্যানেল থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে এই গ্রামের সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি গ্রামের সৌন্দর্য্যবর্ধন এবং বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ইউটিউব পার্ক।
ঝাউদিয়া শাহী মসজিদ
কুষ্টিয়া সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে ঝাউদিয়া গ্রামে এ মসজিদ অবস্থিত। ইট, পাথর, বালি ও চিনামাটির মিশ্রণে এ মসজিদটি এক ঐতিহ্যের চমৎকার নিদর্শন। মসজিদটি শৈল্পিক কারুকার্য ও টেরাকোটায় অনিন্দ্য সুন্দর হয়েছে। মসজিদটির মূল কাঠামোতে তিনটি গম্বুজ ও তিনটি দরজা রয়েছে। এ জায়গায় কুষ্টিয়া থেকে ৫০ টাকা অটোরিকশা ভাড়ায় যাওয়া যায়।
লালন শাহ সেতু ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ
কুষ্টিয়া সদর থেকে ৩১ কিলোমিটার দূরে ভেড়ামারা উপজেলায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অবস্থিত। লর্ড হার্ডিঞ্জের নামানুসারে এ ব্রিজের নামকরণ করা হয়েছে। ১০০ বছরের অধিক পুরোনো ব্রিজটি নানা ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। এ ব্রিজের পাশেই লালন শাহ সেতু। বাউল সম্রাট লালনের নামে এ সেতুর নামকরণ করা হয়েছে। সেতুটি পাবনা আর কুষ্টিয়ার মাঝে মেলবন্ধন সৃষ্টি করেছে। একসঙ্গে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতু দেখতে এখানে প্রতিদিন অনেক পর্যটক যান।
দেশের প্রথম রেলস্টেশন জগতি
কুষ্টিয়ার জগতি স্টেশনও একসময় ব্যস্ত জংশন ছিল। দেশের পুরোনো এই স্টেশন এখন কোনোরকমে টিকে আছে। দালানের লাল ইটের রং ফিকে হয়ে এসেছে, টেলিফোনগুলো অকেজো। বসার জায়গা নেই, বাতি, পানি, শৌচাগারও নেই। তারপরও যে কেউ চাইলেই ঘুরে দেখতে পারেন কালের সাক্ষী জগতি স্টেশন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
কুষ্টিয়া শহর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া-খুলনা মহাসড়কের পাশে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। দৃষ্টিনন্দন এ বিশ্ববিদ্যালয়টি চাইলেই ঘুরে দেখতে পারেন।