শহরটি ঘুমায় না। জাঁকজমকপূর্ণ শহরটিকে বলা হয় ভালোবাসার রাজধানী, ভালোবাসার তীর্থস্থান। সবসময় উৎসবের আমেজ লেগেই থাকে। বলা হচ্ছে ফ্রান্সের প্যারিসের কথা। এত জৌলুসপূর্ণ শহর পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্যারিসের রাস্তায় দাঁড়ালে যে কারো মনে হতেই পারে যেন ভালোবাসার কল্পনার রোমান্টিক ফানুসে উড়ছেন।
প্যারিসের আইফেল টাওয়ার ঘেঁষেই বয়ে গেছে সিন নদী। এই নদীর ওপর আছে প্রসারিত দুটি ধাতব সেতু। সেতু দুটি প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান। সেখানে গেলেই যে কারো দৃষ্টি কাড়বে সেতুর রেলিংজুড়ে নানান আকার ও ধরনের রাশি রাশি চাবিহীন তালা। একটিকে জড়িয়ে আরেকটি, নেই কোনো ফাঁকফোকর। তালাগুলো যেন গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ।
লুভ্র জাদুঘরের সামনে এবং নটর ডাম দ্য পারির পেছনে সেতু দুটির অবস্থান। সেখানে বহু প্রেমিকযুগল এসে ‘সুখে-দুঃখে চিরদিন একসঙ্গে থাকার প্রতিজ্ঞা করে একটি তালা আটকে চাবিটি নদীর অথই পানিতে ফেলে দিয়ে যান। দুটি প্রাণের প্রেমের উচ্ছ্বাস, আজীবন একে অন্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার প্রতিজ্ঞার সাক্ষী হয়ে ঝুলতে থাকে তালা। ধাতব তালার কঠিন বাহুতে চিরবন্দী ভালোবাসা।
দুটি সেতুর একটির নাম ‘পঁ দে আর্টস’। ২০১৪ সালে প্রায় ১০ লাখ তালার ভারে সেতুর একাংশ ভেঙে সিন নদীতে পড়ে যায়। তাতে পৌর কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। ভালোবাসার ভার সইতে না পেরে পুরো সেতুটি ধসে পড়তে পারে আশঙ্কায় সেখান থেকে সরিয়ে নেয় প্রায় ৬৫ টন তালা! কদিন পরেই আবারও তালার বিশাল সমাহারে সেতুর হাড় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এরপর থেকে নানানভাবে চেষ্টা করা হয় তালা প্রতিরোধ করার জন্য। কিন্তু তা থামানো যায় না। ভালোবাসা সংক্রামক রোগের মতো, নগরীর আনাচেকানাচে দেখা মেলে ভালোবাসার চাবিহীন তালা। এমনকি আইফেল টাওয়ারেও পাওয়া গেছে প্রায় ৪০টি তালা।
প্যারিসের সেতুগুলোর মতোই জার্মানির কোলন শহরের হোহেনসোলার্ন সেতু এবং আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনের হা পেনি সেতুটিও এই ভালোবাসার তালা বা লাভ লক ঝোলানোর জন্য বিখ্যাত। অবশ্য ২০১২ সালে ডাবলিনের সিটি কাউন্সিল সেতুতে ভালোবাসার তালা ঝোলানো নিষিদ্ধ করে এবং শহরের যেকোনো সেতুতে এমন তালা দেখা গেলেই তা সরিয়ে ফেলার ঘোষণা দেয়। তবে, জনগণের তোপের মুখে কোলনের সেতুতে লাভ লক নিষিদ্ধের চেষ্টা থেকে বিরত হয় নগর কর্তৃপক্ষ।
ভালোবাসার তালা সংস্কৃতি কবে, কোথা থেকে শুরু হয়েছিল, তা কেউ বলতে পারে না। পৃথিবীর বহু দেশে তা ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপের অনেক শহর, বন্দরে এমন তালার দেখা পাওয়া যায়। তবে রোমের হৃদয়হীন পৌর কর্তৃপক্ষ তালার জ্বালা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য জরিমানার খড়গ হাতে ঘাটে ঘাটে পাইক-পেয়াদা বসিয়েছে। কাউকে হাতেনাতে ধরতে পারলেই করা হয় ৫০ ইউরো অর্থদণ্ড।
সে যাই হোক, ভালোবাসায় তালা-চাবির অস্তিত্ব নেই, জোর-জবরদস্তির কোনো জায়গা নেই। কারণ প্রতিটি মানুষের মনের জগতে, ভাবনার জগতে একেকটা অদৃশ্য সিন্দুক থাকে। সেই সিন্দুকের চাবি শুধু নিজের কাছেই থাকে। সারাটি জীবন সেই সিন্দুক যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখে মানুষ। অদৃশ্য সেই জাদুর সিন্দুকে কার জন্য ভালোবাসা গচ্ছিত আছে তা তার কাছের মানুষটিও জানে না, কোনো দিনও জানতে পারে না। ভালোবাসা ধরাছোঁয়া যায় না, তালাবন্দী করা যায় না।