বিহারে প্রথম দফায় রেকর্ড ভোট, নেপথ্যে যে কারণ

ভারতের বিহার রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে ভোট গ্রহণ চলছে। এর প্রথম দফায় ১২১টা আসনে রেকর্ড ৬৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট পড়েছে।

তেজস্বী যাদব, তেজ প্রতাপ যাদব এবং সম্রাট চৌধুরীসহ ১৩১৪ জন প্রার্থীর ভাগ্য কী হতে চলেছে, তা ইতিমধ্যে ইভিএমে (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনে) বন্দি হয়েছে ৬ নভেম্বর, প্রথম দফার ভোটে।

শুধু বিধানসভা নির্বাচনই নয়, ১৯৫২ সাল থেকে শুরু হওয়া লোকসভা ভোটের তুলনাতেও চলতি বছরে বিহারের বিধানসভার প্রথম দফায় সর্বোচ্চ ভোটদান দেখা গিয়েছে।

ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার একে ঐতিহাসিক ভোটদান হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

পরিসংখ্যান কী বলছে?

পরিসংখ্যান বলছে ১৯৫১-৫২ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে ভোটের হার মাত্র তিনবার ৬০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

১৯৯০ সালে ৬২ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ১৯৯৫ সালে ৬১ দশমিক ৭৯ শতাংশ এবং ২০০০ সালে ৬২ দশমিক ৫৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল বিহারে।

এদিকে, চলতি বছরে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় তিন কোটি ৭৫ লাখ ভোটার বিহারের মোট ২৪৩টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৮টা জেলার ১২১টা আসনে ৬৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট দিয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ২০২০ সালে প্রথম দফায় বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে ৫৬ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পড়েছিল।

অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম দফায় ভোট গ্রহণে প্রায় আট শতাংশ বেশি। তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে সেই সময় প্রথম ধাপে ৭১টা আসনে ভোট গ্রহণ হয়েছিল।

রেকর্ড পরিমাণ ভোটের নেপথ্যে এসআইআর?

বিহারে গত ৩৫ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন সুরুর আহমেদ। তার মতে, ভোটের হার বৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে একটা এসআইআর অর্থাৎ স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন (বিশেষ নিবিড় সংশোধন)।

এসআইআর ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা সংশোধনের একটা প্রক্রিয়া।

এই প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, ‘মৃত্যু হয়েছে, অন্যত্র চলে গিয়েছেন ও অস্তিত্বহীন ভোটার মিলিয়ে প্রায় আট শতাংশ ভোট এর ফলে বাদ গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এটা লক্ষণীয় যে ভোটারের হার কমলেও ভোটের হার বেড়েছে।’

‘এর একটা সম্ভাব্য কারণ হতে পারে দুই মাস যাবত চলা এসআইআর-এর প্রক্রিয়া। এই সময়ে মানুষ ভয় পেয়েছেন, সতর্কও হয়েছেন, যা হয়তো ভোটারদের বুথে টেনে আনার একটা কারণ হতে পারে। এই কারণে ভোটের হার বৃদ্ধি হয়ে থাকতে পারে।‘

‘টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেস‘-এর সাবেক অধ্যাপক পুষ্পেন্দ্র কুমার মনে করেন, এসআইআর-এর কারণে ভোটদানের হার আট শতাংশ বাড়তে পারে। তার কথায়, ‘এসআইআর-এ ভোটারদের নাম বাদ দেয়া ভোটের শতাংশ বৃদ্ধির পেছনে একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে।’

জুন মাসে বিহারে সাত কোটি ৮৯ লাখ ভোটার ছিল। কিন্তু এসআইআর-এর পর ওই সংখ্যা ছয় শতাংশ কমে গিয়ে তা সাত কোটি ৪২ লাখে দাঁড়িয়েছে।

গত বেশ বছর ধরে নির্বাচনের সময় ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ করছেন সমাজকর্মী রূপেশ। তার কথায়, ‘এসআইআর-এর পর ভোটারদের একাংশের মধ্যে প্রচুর উৎসাহ তৈরি হয়েছে। ভোট দেয়ার নামে মানুষের তাদের আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি প্রমাণ করতে চাইছে।’

এই প্রসঙ্গে আরো একটা সম্ভাবনার কথা বলেছেন সুরুর আহমদ। তিনি মনে করেন ভোটের হার বৃদ্ধির পেছনে ক্ষমতাসীনদের বিরোধিতাও অন্যতম কারণ হতে পারে। কারণ তিনি মনে করেন ক্ষমতাসীনদের প্রতি সমর্থন এত বিপুল সংখ্যক ভোটারকে বুথে আনতে পারে না।

তবে অনলাইন সার্ভে এজেন্সি পিপলস পালসের সাথে যুক্ত ডেটা অ্যানালিস্ট ড. রাজন পান্ডে বলেন, ‘এসআইআর এর অন্যতম কারণ, যার অর্থ এখন আমরা র‍্যান্ডম এক্সাম্পলস-এর মাধ্যমে এটাই বলতে পারি যে মানুষের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে আমরা ভোট না দিলে কল্যাণমূলক প্রকল্প থেকে আমাদের ভাগটা বাদ দিয়ে দেয়া হবে।’

তার মতে, এই আশঙ্কা শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই নয়। বেশ পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষের মধ্যেও রয়েছে। কারণ তারাও এই সমস্ত কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো থেকে বড় আকারের সুবিধা পান।

পুষ্পেন্দ্র কুমার বলেন, ‘ভোটের হার বৃদ্ধির অন্যান্য কারণ থাকতে পারে, যা মূল্যায়ন করতে অনেক সময় লাগবে। তাহলেই ভোটের হার বৃদ্ধির প্রকৃত অর্থ বোঝা যাবে।’

এই প্রসঙ্গে আরো একটা উল্লেখযোগ্য তথ্য তুলে ধরেছেন ড. রাজন পান্ডে। তার মতে, ‘এই বেড়ে যাওয়া ভোটের মধ্যে পুরুষ ও নারীর ব্রেকআপ (আলাদা আলাদা করে পুরুষ ও নারী ভোটারের হার) আমাদের কাছে নেই। এই ব্রেকআপ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এর কারণ বিহারে নারী ভোটারদের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে নীতীশের (কুমার)-এর প্রতি ভোট দেয়ার প্রবণতার সম্পর্ক রয়েছে।’

ভোটের হার বৃদ্ধিতে নারী ভোটারদের অবদান

বিহারে ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং সেখানে নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ড. রাজন পান্ডে বলেন, ‘এর অন্যতম কারণ হলো ‘জীবিকা‘, যা ইতিমধ্যে ভারতের সমস্ত রাজ্য গ্রামীণ জীবিকা মিশনের শীর্ষ তিন বা শীর্ষ পাঁচে রয়েছে এবং এর পরিধিও বেশ মজবুত।’

প্রসঙ্গত, ‘জীবিকা‘, যার আনুষ্ঠানিক নাম বিহার রুরাল লাইভলিহুডস প্রোমোশন সোসাইটি, এটি বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিহার সরকারের একটা উদ্যোগ। এর লক্ষ্য গ্রামের দরিদ্রদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন।

ড. রাজন পান্ডে বলেন, ‘জীবিকার মাধ্যমে নারীদের অ্যাকাউন্টে প্রচুর অর্থ ঢুকেছে। অন্যদিকে, উত্তর ভারতের কোনো রাজ্যে যদি নারী ভোট ব্যাংক থেকে থাকে, তাহলে সেটা বিহারে। এর সাথে (নারী ভোটারদের সাথে) নীতীশ কুমারের সম্পর্ক খুবই দৃঢ়।’

তিনি বলেন, ‘নীতীশ কুমার যে পদক্ষেপই গ্রহণ করেছেন, তা সে মদের উপর নিষেধাজ্ঞা হোক, জীবিকা নামক প্রকল্প হোক বা মেয়েদের জন্য সাইকেলসহ অন্যান্য বিষয়, শুরু থেকেই তিনি নারী ভোট ব্যাংক গড়ে তুলেছেন।’

বিহারের প্রবীণ সাংবাদিক কানহাইয়া ভৈলারি ড. পান্ডের সাথে একমত। তিনি বলেন, ‘নীতীশ সরকার নারীদের অ্যাকাউন্টে যে ১০ হাজার টাকা দিয়েছে তা সম্ভবত তাদের ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে টেনে আনার একটা বড় কারণ হতে পারে।’

তবে ড. রাজন পান্ডে আরও এক সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তার কথায়, ‘ঐতিহ্যগতভাবে বেশি সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতিকে পরিবর্তনের আনার জন্য ভোটদান হিসাবে দেখা যেতে পারে। বেশি সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি মানে পরিবর্তন আসবে। তবে একে থাম্ব রুল হিসেবে ধরে নিতে পারি না।’

সমাজকর্মী রূপেশও মনে করেন যে ভোটের হার বৃদ্ধি ওই রাজ্যে ক্ষমতা পরিবর্তনের লক্ষণ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘তৃণমূল স্তরে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে বদল (রাজনৈতিক) সম্পর্কে আশা চোখে পড়েছে। তবে এই যুবকদের ভোট মহাজোটের দিকে গিয়েছে নাকি প্রশান্ত কিশোরের দিকে, তা বলা যাচ্ছে না।’

অভিবাসীদের ভূমিকা

বিহার অভিবাসীদের রাজ্য হিসেবে পরিচিত। বিহারের বাসিন্দাদের একটা বড় সংখ্যা অন্যত্র কাজের সন্ধানে যান। এই পরিস্থিতিতে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে ভোটের হার বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সেই সমস্ত অভিবাসীদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

ড. রাজন পান্ডে বলেন, ‘ছট পূজোর কাছাকাছি সময়ে নির্বাচনের সময় রাখা হয়। যাতে মানুষ যদি ছট পূজোর সময় বাড়ি এলে আরো কিছুদিন থেকে গিয়ে ভোট দেন এবং তারপর (কর্মস্থলে) ফিরে যেতে পারেন।’

‘এবার দুইয়ের মাঝে ব্যবধান অনেকটাই বেশি ছিল। কিন্তু সাধারণত কোনো ব্যক্তি যদি এত কষ্ট করে ছট পূজোয় আসেন, তবে তিনি নিজের পৈতৃক ভিটেতে কিছুদিন অন্তত থেকে যান।’

উৎসবের মৌসুমে এই ধরনের অভিবাসী ভোটাররা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন যদি তাই হয়, তবে ভোটের হার বৃদ্ধির পিছনে কি রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয়তাও রয়েছে?

এই প্রশ্নের উত্তরে ড. রাজন পান্ডে বলেন, ‘এই বিষয়ে এখনো পর্যন্ত এটাই লক্ষ্য করা গিয়েছে, বিজেপি হরিয়ানা থেকে কিছু লোককে বিহারে ভোট দেয়ার জন্য পাঠিয়েছে। তবে অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেমন আরজেডি, জেডিইউ বা কংগ্রেস কারো ক্ষেত্রেই এমন উদাহরণ মেলেনি।’

এ বিষয়ে সাংবাদিক কানহাইয়া ভৈলারি বলেন, ‘আমার মনে হয়, যে অভিবাসীরা ওই সময় এসেছিলেন তারা বাড়িতে থেকে নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। তাদের থেকে যাওয়ার আরো একটা বড় কারণ ধান, এই সময় ফসল কাটা হচ্ছে। সেই কারণেই একটা বড় সংখ্যক মানুষ থেকে গিয়েছেন।’

কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয়তা সম্পর্কে পুষ্পেন্দ্র কুমার বলেন, ‘এসআইআর আগে ভোটারদের নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল।’

‘এরপরই বিজেপি খবরের কাগজে বেশ কয়েক পৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন দেয়। অন্যদিকে, আরজেডির মতো দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নির্বাচনী প্রচার করে ভোটারদের সক্রিয় করেছে।’

‘প্রশান্ত কিশোরের টিম পুরো মাত্রায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার করেছে, যা ভোটারদেরও উৎসাহ দিয়েছে।’

ড. রাজন পান্ডে অবশ্য বলছেন, মনে করেন বিজ্ঞাপন নতুন কিছু নয়, আগেও এটা দেখা গিয়েছে। সূত্র : বিবিসি