যুদ্ধের ইতি টানতে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ‘কোনো আপস’ হয়নি। মস্কোয় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তাদের বৈঠকের পর এক রুশ কর্মকর্তা এ কথা জানিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও প্রেসিডেন্টের জামাতা জ্যারেড কুশনার মঙ্গলবার ক্রেমলিনে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে মারাত্মক যুদ্ধের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার অংশ হিসেবে তাঁরা এ বৈঠক করেন। এ বৈঠক প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলে এবং মধ্যরাতের পর শেষ হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ক্রেমলিনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ইউরি উশাকভ। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা কোনো আপসে পৌঁছাতে পারিনি। তবে মার্কিন কিছু প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা এগোতে পারে।’
উশাকভ মঙ্গলবারের আলোচনাকে ‘খুবই ইতিবাচক ও গঠনমূলক’ উল্লেখ করলেও তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ওয়াশিংটন ও মস্কো— উভয় পক্ষের সামনে এখনো অনেক কাজ বাকি।’
মার্কিন প্রতিনিধিদল একটি শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে রাশিয়ার রাজধানীতে গিয়েছিল। সেখানে আগের ফাঁস হওয়া ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনার খসড়ার হালনাগাদ সংস্করণ নিয়ে আলোচনা হয়। ফাঁস হওয়া ‘খসড়াটি রাশিয়ার পক্ষে গেছে’— ইউক্রেন ও দেশটির মিত্রদের এমন কঠোর সমালোচনার মুখে ওয়াশিংটন এতে পরিবর্তন আনে।
কিয়েভ ও ইউরোপের পাল্টা প্রস্তাবটিরও নিন্দা করেছে ক্রেমলিন। পুতিন বারবার বলে আসছেন, এটি তাঁর দেশের কাছে ‘অগ্রহণযোগ্য’।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের আগে প্রেসিডেন্ট পুতিন একটি বিনিয়োগ ফোরামে কড়া বক্তব্য দেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, তাঁর দেশ ইউরোপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত।
ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্রদের ইঙ্গিত করে পুতিন বলেন, ‘তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেই রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে, (শান্তি পরিকল্পনায়) এসব পরিবর্তনের একটাই লক্ষ্য— পুরো শান্তি প্রক্রিয়াকে আটকে দেওয়া। এমন সব দাবি তোলা হচ্ছে যা রাশিয়ার কাছে পুরোপুরি অগ্রহণযোগ্য।’
৭৩ বছর বয়সী পুতিন আরও বলেন, তুরস্ক উপকূলে রুশ তেলবাহী জাহাজে হামলার পর ইউক্রেনীয় বন্দর ও জাহাজে, এমনকি কিয়েভের সমর্থকদের তেলবাহী ট্যাঙ্কারেও হামলা বাড়াবে রাশিয়া।
পুতিনের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রি সিবিহা বলেন, এটা স্পষ্ট যে, পুতিন চান না যুদ্ধ শেষ হোক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘গতকাল তিনি বললেন, পুরো শীতকালজুড়েই লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। আজ তিনি সমুদ্রবন্দর ও নৌ চলাচলের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি দিচ্ছেন।’
ট্রাম্প তাঁর দিক থেকে স্বীকার করেছেন যে সমঝোতার আলোচনা কঠিন। ওয়াশিংটন ডিসিতে কেবিনেট বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকজন এখন রাশিয়ায় আছে এটা দেখার জন্য যে, আমরা বিষয়টা মিটমাট করতে পারি কি না।’
এদিকে আয়ারল্যান্ড সফরকালে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, একটি ‘সম্মানজনক শান্তি (চুক্তি)’ প্রয়োজন।
ডাবলিনে এক অনুষ্ঠানে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র শান্তি প্রক্রিয়া ওপর আগ্রহ হারাতে পারে কি না। জবাবে তিনি বলেন, তার ভয় কিয়েভের মিত্ররা ‘ক্লান্ত’ হয়ে পড়তে পারে।
জেলেনস্কি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এই পরিস্থিতি থেকে আমেরিকার আগ্রহ সরিয়ে নেওয়াই রাশিয়ার লক্ষ্য।’
ট্রাম্প তাঁর দিক থেকে স্বীকার করেছেন যে সমঝোতার আলোচনা কঠিন। ওয়াশিংটন ডিসিতে কেবিনেট বৈঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের লোকজন এখন রাশিয়ায় আছে এটা দেখার জন্য যে, আমরা বিষয়টা মিটমাট করতে পারি কি না।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘সহজ পরিস্থিতি নয়, সেই এক বিশৃঙ্খল অবস্থা!’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই যুদ্ধ প্রতি মাসে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে।
এই জোর কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যেই রাশিয়া দাবি করেছে, তারা ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলের ‘বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ’ শহর পোকরোভস্ক দখল করে নিয়েছে। তবে কিয়েভ এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে, মস্কো এমন ধারণা তৈরি করতে চায়, যেন রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
পোকরোভস্ক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে মঙ্গলবার পুতিন বলেছেন, ‘এই ঘাঁটি থেকে, এই সেক্টর থেকে, রাশিয়ার সেনাবাহিনী সহজেই যে কোনো দিকে অগ্রসর হতে পারে, যেটা সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব (জেনারেল স্টাফ) সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখছে।’
রুশ বাহিনী এখন ইউক্রেনের ১৯ শতাংশের বেশি ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে, যা গত বছরের তুলনায় এক শতাংশ বেশি। যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে ইউক্রেনপন্থী একটি মানচিত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলেছে, ২০২২ সালের পর ২০২৫ সালেই সবচেয়ে দ্রুত এগিয়েছে রুশ বাহিনী।
এদিকে ফাঁস হওয়া মার্কিন খসড়া শান্তি প্রস্তাবে রাশিয়ার দাবি ছিল, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর আকার সীমিত রাখা, পুরো দনবাসের নিয়ন্ত্রণ এবং জাপোরিঝিয়া ও খেরসনে রাশিয়ার উপস্থিতির স্বীকৃতি দেওয়া।
কিয়েভ বলেছে, এমন ছাড় দেওয়া মানে কার্যত ‘আত্মসমর্পণ’। আর জেলেনস্কি বলেছেন, চলমান সমঝোতার আলোচনায় ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা রক্ষা করাই ‘সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ’।